ঢাকা,  সোমবার
১৪ জুলাই ২০২৫

Advertisement
Advertisement

ঋতুপর্ণা চাকমার বাঁ পায়ের জাদুতে ইতিহাস: হার না মানা এক পাহাড়ি কন্যার গল্প

প্রকাশিত: ২০:২৩, ২ জুলাই ২০২৫

ঋতুপর্ণা চাকমার বাঁ পায়ের জাদুতে ইতিহাস: হার না মানা এক পাহাড়ি কন্যার গল্প

ঋতুপর্ণা চাকমা

আপনি তাঁর নামের পাশে কী বিশেষণ বসাবেন? অনন্য? অসাধারণ? হয়তো কোনো শব্দই যথেষ্ট নয়। কারণ, ঋতুপর্ণা চাকমার খেলা শব্দের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে বহু আগেই। মিয়ানমারের বিপক্ষে তাঁর বাঁ পায়ের দুটি গোল যেন ছিল শুধুই গোল নয়, ছিল বিস্ময়! এমন গোলের পর শব্দ ফুরিয়ে আসে, বাক্য থমকে যায়। বয়স মাত্র ২১, কিন্তু তাঁর পায়ে যেন সময়ের চেয়েও দ্রুত ছুটে চলে সম্ভাবনার বিদ্যুৎ।

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের ইতিহাসে এক নতুন সূর্যোদয়ের পথে যে কয়েকটি নাম পথপ্রদর্শকের মতো জ্বলে উঠেছে, তার কেন্দ্রে আছেন এই পাহাড়ি তরুণী। ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ৭৩ ধাপ এগিয়ে থাকা মিয়ানমারকে ২-১ গোলে হারানোর ম্যাচে বাংলাদেশের দুই গোলই ঋতুপর্ণার। দুটিই বাঁ পায়ে।

একটি গোল, এক বিস্ময়
প্রথম গোলটিতে দেখা গেছে ঋতুপর্ণার চমৎকার বোঝাপড়া ও উপস্থিত বুদ্ধি। ফ্রি-কিক থেকে মিয়ানমারের প্রাচীর ডিঙিয়ে ফিরে আসা বলটি আবারও নিজের দখলে নিয়ে নিখুঁত প্লেসিংয়ে বল জড়িয়ে দেন জালে। দ্বিতীয় গোলটি যেন এক অলৌকিকতা—বাঁ প্রান্ত থেকে ডান পায়ের মতো শটে গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে বল চলে যায় জালে। স্তব্ধ হয়ে যায় থুউন্না স্টেডিয়াম।

অন্ধকার থেকে আলোয়
তাঁর পায়ের আলো আজ বাংলাদেশের গর্ব হলেও, ঋতুপর্ণার পথচলা সহজ ছিল না। রাঙামাটির প্রত্যন্ত গ্রাম মগাছড়ি থেকে উঠে আসা মেয়েটির শৈশব কেটেছে দারিদ্র্যে। বাবা বরজ বাঁশি চাকমা ছিলেন কৃষক, পরে ক্যানসারে মারা যান। পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মেয়েটি ফুটবলই আঁকড়ে ধরেন। ছোট ভাই পার্বণ চাকমার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু তাঁর জীবনে বয়ে আনে আরও এক অদৃশ্য ঘাত। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েননি। লড়াই করেছেন। সেই লড়াই আজ তাঁকে এনে দিয়েছে ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে।

২৯ জুন, ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে বাহরাইনের বিপক্ষে মাঠে নামেন ঋতু। খেলার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইয়ের সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করে লেখেন, ‘আজ তোমার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী সিজি, তোমায় অনেক ভালোবাসি।’ সেই শোক তাঁকে শক্তি দেয়, এগিয়ে যেতে শেখায়। ঠিক যেমন ২০২২ সালে ছোট ভাইকে হারানোর দিনে জাতীয় দলের জার্সিতে গোল করেছিলেন তিনি।

শিল্পের নাম ঋতুপর্ণা
২০২২ ও ২০২৪—দুইবার সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের গর্বিত সদস্য ঋতুপর্ণা। প্রথমবার আলো ছিল সাবিনা খাতুনের ওপর। এবার কাঠমান্ডুতে সেই আলোয় জায়গা করে নেন ঋতু। ফাইনালে তাঁর বাঁ পায়ের গোলটি আজও ভেসে বেড়ায় অনেকের চোখে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়ায় একটি বাক্য—‘ঋতু, ইউ বিউটি।’ কেউ কেউ তো বলেই দিয়েছেন, “এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সেরা অ্যাথলেট হলেন ঋতুপর্ণা চাকমা।”

জেদ আর প্রতিভার এক নাম
তাঁর বাঁ পায়ের শটে যেমন নিখুঁততা, তেমনি গতি ও বল নিয়ন্ত্রণেও ঋতু বিস্ময়কর। সেই কারণেই কোচ পিটার বাটলার বাদ দিতে পারেননি তাঁকে। যদিও গত ৩০ জানুয়ারি ১৮ নারী ফুটবলারের বিদ্রোহে তিনি ছিলেন সরব, তারপরও নতুন দল গঠনে মনিকা, মারিয়া, তহুরার মতো ঋতুকেও রেখেছেন কোচ। কারণ, পিটার বাটলার জানতেন—ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কাদের হাতে থাকে।

বাঁ পায়ের জাদুতে ইতিহাসের সামনে বাংলাদেশ
ভুটানে লিগ খেলতে থাকা ঋতু ছুটি নিয়ে ফিরে এসে জর্ডান সফরের পর অংশ নেন মিয়ানমার সফরে। এই সফরের ফলাফলই ইতিহাস। কারণ, বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল এবারই প্রথম এশিয়ান কাপের মূল পর্বে খেলতে যাচ্ছে—এমন সাফল্যের হাতছানি ত্বরান্বিত হয়েছে ঋতুপর্ণার সেই দুই গোলেই।

জীবনের কাছে শিখেছেন, হার মানা যায় না
এক দশক আগে পিতৃহারা হওয়া মেয়েটি আজ বাংলাদেশের মেয়েদের লড়াই-সংগ্রামের প্রতীক। তিনি গোল করেন, কারণ জীবন তাঁকে শিখিয়েছে, হার মানা যাবে না। একটি বাঁ পায়ের শট দিয়েই ইতিহাস লেখা যায়, তা তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন।

আজ তাই তিনি শুধু একজন ফুটবলার নন—একটি অনুপ্রেরণা, একটি প্রতীক। যিনি পাহাড় পেরিয়ে মাঠ দখল করে নিয়েছেন নিজের অসাধারণতা দিয়ে। যাঁর নামের পাশে ‘অসাধারণ’, ‘অনন্য’—এমন কোনো বিশেষণই যথেষ্ট নয়।

ঋতুপর্ণা চাকমা—একটি নাম, এক গল্প, এক জাদু।

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531