ঢাকা,  বৃহস্পতিবার
২৮ আগস্ট ২০২৫

Advertisement
Advertisement

মেট্রোরেল চলছে, যাত্রী ঠাসাঠাসি—তবু ঋণ শোধে লাগবে ৫০ বছর

প্রকাশিত: ১২:৫৪, ৬ আগস্ট ২০২৫

আপডেট: ০৮:৪৯, ৭ আগস্ট ২০২৫

মেট্রোরেল চলছে, যাত্রী ঠাসাঠাসি—তবু ঋণ শোধে লাগবে ৫০ বছর

সরকারি ভর্তুকি ছাড়া ব্যয় উঠে আসবে না, বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চালু হওয়া মেট্রোরেল এমআরটি-৬ প্রতিদিন গড়ে চার লাখ যাত্রী বহন করলেও এর আয়ে প্রকল্পের বিপুল ঋণ শোধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মেট্রোরেল এখনো লাভজনক হয়নি, বরং আগামী কয়েক দশক ধরে সরকারের ভর্তুকি দিয়ে এর ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর গণপরিবহনে যুগান্তকারী এই প্রকল্পটি নগরবাসীর চলাচলে গতি আনলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে তা এখনো চাপের মুখে।

আয়ের চেয়ে ঋণের কিস্তি বেশি

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মেট্রোরেলের প্রভিশনাল (অনিরীক্ষিত) আয় হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। অথচ একই সময় জাইকার কাছ থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি হিসেবে দিতে হবে প্রায় ৪৬৫ কোটি টাকা। পরবর্তী বছরগুলোতে এই কিস্তি আরও বাড়বে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৩০-৩১ অর্থবছর পর্যন্ত গড়ে বছরে ৭৪০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

বছরে ৭০০ কোটি আয় হলেও লাগবে ৫০ বছর

ডিএমটিসিএল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মেট্রোরেলের টিকিট বিক্রি থেকে বছরে যদি ৭০০ কোটি টাকাও আয় হয়, তবুও নির্মাণ ব্যয় উঠে আসতে ৫০ বছরের বেশি সময় লেগে যাবে। কারণ প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা, যার মধ্যে প্রায় ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা জাইকা থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, ঋণের একটি অংশের গ্রেস পিরিয়ড ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে এবং ২০২৩ সাল থেকে সীমিত পরিসরে কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত পরিশোধ হয়েছে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা, এবং চলতি অর্থবছরেই আরও ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।

যাত্রী বেশি, আয় কম—কারণ কী?

এমআরটি-৬ লাইনে যাত্রীচাপ বেশি হলেও টিকিটের দাম আর বাড়ানোর সুযোগ নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন,

“ঢাকার মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় আশপাশের দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে ভাড়াও তুলনামূলক বেশি। এই অবস্থায় ভাড়া বাড়িয়ে আয় বাড়ানো কঠিন।”

তিনি আরও বলেন,

“ট্রেনের সংখ্যা ও চলাচলের সময় বাড়ানো, স্টেশন এলাকায় বাণিজ্যিক জায়গা ভাড়া দেওয়া, পার্কিং ব্যবস্থা চালু করাসহ বিভিন্ন উপায়ে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।”

চলাচলের সময় সীমিত, ট্রেন কম

প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ব্যস্ত সময়ে ৩.৫ মিনিট পরপর ট্রেন চলবে। বাস্তবে এখন ৮–১২ মিনিট পরপর ট্রেন চলাচল করছে।
এ ছাড়া রাত ১০টার পর মেট্রোরেল বন্ধ থাকে, ফলে সম্ভাব্য আয়ের একটি অংশ হারিয়ে যাচ্ছে।

ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন,

“আমরা ট্রেনের সংখ্যা ও চলাচলের সময় বাড়াতে লোকবল নিয়োগ করছি। পাশাপাশি স্টেশনের অব্যবহৃত জায়গায় দোকান বরাদ্দ দিয়ে অতিরিক্ত আয়ের চেষ্টা করছি।”

রক্ষণাবেক্ষণের খরচও বাড়ছে

এখনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রপাতির দেখভাল করছে। কিন্তু ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিএমটিসিএল-কে নিজস্ব খরচে এসব পরিচালনা করতে হবে।
এতে করে বছরে ১০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে।

ভবিষ্যতের মেট্রো প্রকল্প আরও ব্যয়বহুল হবে

সরকার আরও পাঁচটি মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়েছে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন,

“এমআরটি-৬ এর চেয়ে অন্য প্রকল্পগুলোয় খরচ কয়েক গুণ বেশি হতে পারে। এগুলোর অর্থের বড় অংশই ঋণ থেকে আসবে। ফলে পরিশোধেও চাপ বাড়বে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন লাইনগুলোর নকশায় ভবিষ্যৎ আয়ের দিকগুলো মাথায় রাখতে হবে। যেসব এলাকায় যাত্রী কম, সেখানে পাতাল রেল বা ব্যয়বহুল নকশা করলে পরবর্তী সময়ে আয় দিয়ে তা পুষিয়ে ওঠা কঠিন হবে।


সারকথা:
ঢাকার মেট্রোরেল রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থায় গতি এনেছে ঠিকই, কিন্তু আর্থিক দিক থেকে এটি এখনো টেকসই হয়ে ওঠেনি। আয়–ব্যয়ের এই ফাঁড়ি সামলাতে সরকারকে নিয়মিত ভর্তুকি দিতে হতে পারে, আর কর্তৃপক্ষকে বাড়তি আয় সৃষ্টির নতুন পথ খুঁজতেই হবে।

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531