ঢাকা,  বৃহস্পতিবার
১২ জুন ২০২৫

Advertisement
Advertisement

৯ দশকের ঐতিহ্যবাহী ইউসুফ বেকারি: পুরান ঢাকার স্বাদ ও ঐতিহ্যের এক অন্যরকম গল্প

প্রকাশিত: ১৬:৪৮, ১০ জুন ২০২৫

আপডেট: ১৬:৩৯, ১১ জুন ২০২৫

৯ দশকের ঐতিহ্যবাহী ইউসুফ বেকারি: পুরান ঢাকার স্বাদ ও ঐতিহ্যের এক অন্যরকম গল্প

বেকারি

পুরান ঢাকার সরু গলিপথে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত পথিক থেকে শুরু করে ভোজনরসিক – সকলের কাছেই এক পরিচিত এবং প্রিয় নাম 'ইউসুফ বেকারি'। জনসন রোডের এই ছোট্ট দোকানটি বাইরে থেকে সাধারণ মনে হলেও, এর ভেতরের গল্প আর খাবারের সম্ভার যেকোনো নতুন ক্রেতাকেই মুগ্ধ করে। 'ইউসুফ কনফেকশনারী' নামে পরিচিত হলেও, এটি 'ইউসুফ বেকারি' নামেই বেশি পরিচিত এবং এর দীর্ঘ ৯ দশকের পথচলা পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আজ থেকে প্রায় ৯ দশক আগে, ১৯৩৯ সালে গোয়ালঘাট এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইউসুফ তার নানা আবদুল ব্যাপারীর কেক-বিস্কুটের ব্যবসার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারে ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টের পাশে গড়ে তোলেন 'ইউসুফ বেকারি'। সে সময় রায়সাহেব বাজার, বংশাল, জনসন রোড ও আশপাশের এলাকায় ব্যবসা ও কোর্ট-কাছারির কাজে বহু মানুষের আনাগোনা ছিল। ফলস্বরূপ, অল্প সময়েই ইউসুফ বেকারির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং বেকারি পণ্যের পরিমাণও বাড়তে থাকে। ১৯৫৮ সালে বেকারিটির স্থান পরিবর্তন হয়ে চলে যায় ১৯/এ জনসন রোডে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেকারি পণ্য ছাড়াও নানা ধরনের নতুন খাবার সংযোজন হওয়ায় এর নাম পাল্টে রাখা হয় 'ইউসুফ কনফেকশনারী'।

দোকানে ঢুকতেই চোখে পড়ে স্টিলের ফ্রেমে বাঁধানো এক বৃদ্ধের সাদাকালো ছবি – ইনিই বেকারির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইউসুফ। ১৯৯০ সালে তার মৃত্যুর পর, তার ১১ ছেলে ও ২ মেয়ে এই ব্যবসার হাল ধরেন। বর্তমানে পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, গুলশান, রমনা, রামপুরা, ধোলাইখালসহ মোট ১২টি শাখা পরিচালনা করছেন মোহাম্মদ ইউসুফের উত্তরসূরিরা।
স্বাদের রহস্য: এক কারখানা, এক মান

ইউসুফ বেকারির সব শাখার খাবারের স্বাদ ও মান একই রকম থাকার পেছনে রয়েছে এক বিশেষ কারণ। পুরান ঢাকার জজকোর্টের পেছনে অবস্থিত একটি কেন্দ্রীয় কারখানাতেই সব খাবার তৈরি হয়। এরপর জনসন রোডের মূল শাখা থেকেই ইউসুফ কনফেকশনারীর সব শাখায় এই খাবার সরবরাহ করা হয়। ইউসুফের ষষ্ঠ ছেলে মোহাম্মদ এয়াকুবের সন্তান ইশরাত জাহান ও মোহাম্মদ ইয়ামিন, যারা জনসন রোডের শাখার দেখাশোনা করেন, জানান যে খাবারের স্বাদ ও গুণগত মানে কোনো পরিবর্তন না আসার জন্যই এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এমনকি স্বত্বাধিকারীদের কেউই তাদের দোকানের জন্য মোড়কজাত পণ্য বাদে ভিন্ন কোনো খাবার বানাতে চাইলে বানাতে পারবেন না।
হরেক রকমের খাবার ও তাদের বিশেষত্ব

ইউসুফ বেকারিতে হরেক রকম খাবারের সম্ভার রয়েছে। এখানে বিস্কুট, পাউরুটি, নিমকি, কেক, চিপসসহ বিভিন্ন বেকারি আইটেম পাওয়া যায়, যার দাম বেশ হাতের নাগালে। এছাড়া, প্যাটিস, বার্গার, রোল, ক্রিম বান, পরোটা, শিঙাড়া – এমন বাহারি ফাস্ট ফুডও তৈরি হয়। অন্যান্য কনফেকশনারির মতো পানীয় ও প্যাকেটজাত খাবারও বিক্রি হয় এখানে।

তবে, ইউসুফ বেকারির বিশেষ আকর্ষণ হলো তৎক্ষণাৎ তৈরি করা চানাচুর। দোকানের কর্মী আকাশ জানান, এখানকার চানাচুরের সব উপকরণ আলাদা আলাদা বয়ামে রাখা হয়। নিজেদের তৈরি টকডাল, মটরডাল, মোটা সেমাই, চিকন সেমাই, মুগডাল, বুন্দিয়া, চিড়া ভাজা, পাপড়, বেসনের গাঠিয়া, বাদামসহ মোট ১১টি পদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় মসলা মিশিয়ে এই মুখরোচক চানাচুর তৈরি করা হয়। কেউ চাইলে নিজের পছন্দমতো উপকরণ কম-বেশি যোগ করেও চানাচুর বানিয়ে নিতে পারেন। এই চানাচুরের উপকরণ তৈরির জন্য আলাদা একটি কারখানা রয়েছে।
বিশেষ দিনে বিশেষ খাবার

শবে বরাত ও রমজান মাসে ইউসুফ বেকারিতে কিছু বিশেষ খাবার যোগ হয়, যা অন্য সময় সচরাচর পাওয়া যায় না। শবে বরাতের সময় মাছ আকৃতির ফ্যান্সি রুটি এখানে বেশ জনপ্রিয়। মানুষ শখ করে দুই থেকে পাঁচ কেজি ওজনের এসব রুটি ফরমাশ দেন। এর সঙ্গে সুজি ও বুটের হালুয়াও থাকে। রমজান মাসে ইফতার আইটেম হিসেবে সুতি কাবাব, জালি কাবাব, হালিম, কাটলেট, জিলাপি, নান এবং গ্রিলড চিকেনও পাওয়া যায়।
ক্রেতাদের আস্থা ও ভালোবাসা

ইউসুফ বেকারিতে সবসময়ই ভিড় লেগে থাকে। আরমানিটোলার বাসিন্দা ও নিয়মিত ক্রেতা জিসান আলম জানান, তিনি বাসার জন্য সব বেকারি খাবার এখান থেকেই নেন। আরেক ক্রেতা সাবিহা নওরীন বলেন, এখানকার ফাস্ট ফুডগুলোর স্বাদ তার বাসার ছোটদের খুব পছন্দের, তাই সবকিছু এখান থেকেই কেনেন।

দোকানে কিছুক্ষণ কাটালেই বোঝা যায়, বেশিরভাগ ক্রেতাই কোনো কিছুর দাম আলাদা করে জানতে না চেয়ে পছন্দের আইটেম তুলে নিয়ে দাম মিটিয়ে চলে যান। এর কারণ, ইউসুফ বেকারির সঙ্গে তাদের জানাশোনা বহুদিনের – এটি কেবল একটি দোকান নয়, এটি তাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
খাবারের দরদাম

ইউসুফ বেকারিতে মুড়ি বিস্কুট, চিড়া বিস্কুট, মিষ্টি বিস্কুট, সলটেড, ড্রাই কেকসহ বিভিন্ন রকমের বিস্কুট পাওয়া যায়, যার দাম কেজিপ্রতি ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। চানাচুরের দাম প্রতি কেজি ৩০০ টাকা। এখানে কয়েক ধরনের প্যাটিস পাওয়া যায়; 'কাপ প্যাটিস' নামে বিক্রি হওয়া এক ধরনের প্যাটিস ৫০ টাকা, রোল প্যাটিস ৬০ টাকা এবং মাটন প্যাটিস ৪০ টাকা। কেকের মধ্যে চকলেট, ফ্রুট, ওভালটিন, প্লেইন কেক, জ্যাম রোলের বেশ কদর। পাউন্ডপ্রতি দাম ১৯০ থেকে ৩০০ টাকা। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী টানা পরোটা প্রতিটি ৩৫ টাকা, চিকেন চিপস ৩০ টাকা এবং আলু চিপস ২০ টাকা। পাউরুটির দাম শুরু ৬০ টাকা থেকে। এখানকার 'ঘোড়ার ডিম' নামের ক্যান্ডির মতো এক খাবারও বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছে, যার প্রতি প্যাকেটের দাম ৩০ টাকা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাবারগুলো কেজিপ্রতি অর্ডার নেওয়া হয়, যেখানে পাইকারি ও খুচরা দামে কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে।

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531