
রাজশাহীতে চাঁদাবাজ
এক ঝলকে ঘটনা
রাজশাহী মহানগরে ঘুরপাক খাওয়া ১২৩ জনের চাঁদাবাজ তালিকা নিয়ে রাজনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক আলোড়ন। রাজনীতির তিন বড় শিবির—বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত—এই তালিকায় তাদের নেতাকর্মীদের নাম থাকায় একদিকে যেমন বিব্রত, অন্যদিকে ক্ষুব্ধও।
তালিকাটি কে তৈরি করেছে—তা নিশ্চিত না হলেও বিভিন্ন পক্ষের ইঙ্গিত, বক্তব্য ও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট, বিষয়টি শুধু অপরাধ নয়, এর সঙ্গে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, প্রশাসনিক পক্ষপাত এবং সুবিধাবাদীদের জোটজটিলতা জড়িত।
তালিকার গঠন ও কাঠামো
তালিকায় মোট ১২৩ জন। তাদের মধ্যে:
-
বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের সদস্য: ৪৪ জন
-
আওয়ামী লীগ ঘরানার ব্যক্তি: ২৫ জন
-
জামায়াতের সদস্য: ৬ জন
-
রাজনৈতিক পরিচয়হীন, সুবিধাবাদী হিসেবে চিহ্নিত: ৪৮ জন
প্রতিটি নামের পাশে নির্দিষ্ট অভিযোগ বা কর্মকাণ্ড উল্লেখ করা হয়েছে—যেমন চাঁদাবাজি, হুমকি, দখলবাজি, মাদকের সংশ্লিষ্টতা, মামলার ভয়ভীতি, ফুটপাত ও কোচিং সেন্টার থেকে চাঁদা আদায় ইত্যাদি।
মামলা ও অভিযোগ
তালিকাভুক্ত ১৮ জনের বিরুদ্ধে একটি আবাসন ব্যবসায়ীর দায়ের করা চাঁদাবাজি মামলা রয়েছে।
এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে ছাত্রদল ও যুবদলের নেতাদের। এতে বলা হয়েছে, এরা বিভিন্ন সময় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেছে।
এই মামলার প্রতিবাদে বিএনপি ইতিমধ্যে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে।
রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া
বিএনপি
রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেছেন:
“এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তালিকা। হয়তো কেউ কেউ দোষী, কিন্তু ঢালাওভাবে দলে দোষ চাপানো মেনে নেওয়া যায় না। প্রশাসনের কেউ কেউ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে তথ্য ফাঁস করছে।”
তিনি আরও বলেন,
“চাঁদাবাজ কারা সেটা খুঁজতে হলে দেখতে হবে কে ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের নামে ঢালাও মামলা দিয়েছে। বাদীরা চাঁদাবাজ হতে পারে।”
আওয়ামী লীগ
তালিকায় ২৫ জন আওয়ামী লীগ ঘরানার ব্যক্তির নাম থাকলেও, দলটি এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে দলীয় সূত্র জানায়, বিষয়টি কেন্দ্রীয়ভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জামায়াত
মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি এমাজ উদ্দিন মণ্ডল বলেছেন:
“তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিদের আমরা দল থেকে সম্পূর্ণ বয়কট করেছি। নেতাদের স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন এদের পাশে কেউ না দাঁড়ায়।”
তিনি আরও বলেন,
“তবে এরা বিভিন্ন সময় ছবি তুলে প্রচার করে বিভ্রান্ত করছে।”
প্রশাসনিক অবস্থান
রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার গাজিউর রহমান বলেছেন:
“আমি তালিকাটি দেখিনি। পুলিশের নয়—এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। সরকার বা গোয়েন্দা সংস্থা অনেক সময় অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণের জন্য এমন তালিকা তৈরি করে।”
তিনি আরও বলেন:
“তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিরা সত্যিই চাঁদাবাজ হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। গণমাধ্যমকর্মীদেরও উচিত পুলিশকে সহযোগিতা করা।”
এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পুলিশ কমিশনারকে তালিকা ও কল রেকর্ড সংক্রান্ত জবাবদিহি চাওয়া হয়েছে।
তালিকায় উল্লেখিত কিছু নাম ও অভিযোগের ধরন:
-
এক ছাত্রদল নেতা: কোচিং সেন্টার থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায়
-
বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক: ৫ আগস্টের পর মামলা দিয়ে হুমকি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ
-
জামায়াতের এক নেতা: ভূমি দখল, সাংবাদিককে হুমকি, উন্নয়ন কাজে বাধা দিয়ে চাঁদা আদায়
-
রাজনৈতিক পরিচয় পরিবর্তনকারী একজন: আগে আওয়ামী লীগ, এখন বিএনপি—তাঁর বিরুদ্ধে গভীর রাতে অস্ত্র হাতে চাঁদাবাজির অভিযোগ
বিশ্লেষণ: এই তালিকা কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত?
বিশ্লেষকদের মতে, তালিকাটি সত্য হলেও এর ব্যবহার ও সময়কাল রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে। বিশেষ করে যখন বিরোধী দলগুলো আবার আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন এমন তালিকা সামনে আসা দমন-পীড়নের পূর্বাভাস বলেই অনেকে আশঙ্কা করছেন।
তবে একে একেবারেই অস্বীকার করাও দায়িত্বজ্ঞানহীন হবে—কারণ স্থানীয় পর্যায়ের চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক পরিচয়ে সন্ত্রাস ও দখলবাজির ঘটনা নতুন নয়।
রাজশাহীর চাঁদাবাজ তালিকা আপাতত রাজনীতির লাল দাগ হয়ে উঠেছে। যদি সত্যি হয়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়, তবে এটি গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ। প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও সমাজ—সবার উচিত স্বচ্ছতা ও ন্যায়ের পথে থাকা। মুখোশধারীদের চিহ্নিত করে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই হতে পারে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের পথ।