ঢাকা,  বৃহস্পতিবার
৩১ জুলাই ২০২৫

Advertisement
Advertisement

ইসরায়েল-ভারতের কৌশলগত ছায়ায় ‘বেলুচিস্তান স্টাডিজ প্রজেক্ট’: ফিলিস্তিনি গবেষকের অনুসন্ধানে নতুন জটিলতা

প্রকাশিত: ১৯:২০, ২৭ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ১৩:১৮, ২৮ জুলাই ২০২৫

ইসরায়েল-ভারতের কৌশলগত ছায়ায় ‘বেলুচিস্তান স্টাডিজ প্রজেক্ট’: ফিলিস্তিনি গবেষকের অনুসন্ধানে নতুন জটিলতা

বেলুচিস্তান

ইরানের ওপর আকস্মিক হামলার প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখ ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের শঙ্কার দিকে, তখন ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক একটি সংস্থার ছোট একটি ঘোষণায় নতুন এক ভূরাজনৈতিক ছায়াযুদ্ধের ইঙ্গিত মিলেছে।

গত ১২ জুন মিডল ইস্ট মিডিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট (মেমরি) নামে ইসরায়েলপন্থী একটি থিঙ্কট্যাংক ‘বেলুচিস্তান স্টাডিজ প্রজেক্ট (বিএসপি)’ নামে নতুন একটি গবেষণা প্রকল্পের ঘোষণা দেয়। তারা দাবি করে, ইরান ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী বেলুচিস্তান অঞ্চলে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে, যার নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

প্রকল্পের পেছনে ভূরাজনৈতিক কৌশল

মেমরি’র এই ঘোষণায় বলা হয়, বেলুচিস্তানে রয়েছে তেল, গ্যাস, ইউরেনিয়াম, বিরল খনিজসহ গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এবং দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর—চাবাহার ও গাদর। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করে, এই অঞ্চল থেকেই ইরান কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে এগোতে পারে, তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নজরদারির একটি ঘাঁটি স্থাপন উচিত।

কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এই তথাকথিত গবেষণা প্রকল্প আসলে ইসরায়েলের এক নতুন কৌশলগত তৎপরতা, যার মাধ্যমে তারা বেলুচদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। ফিলিস্তিনি লেখক ও গবেষক আবদুল্লাহ মোয়াসওয়েস মনে করেন, এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল শুধু ইরান ও পাকিস্তানের ভেতরকার দুর্বল জায়গাগুলোতে ঢুকে পড়ছে না, বরং ‘রাষ্ট্রহীন’ জনগোষ্ঠীগুলোর—যেমন বালুচ ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে গড়ে ওঠা সংহতিকেও দুর্বল করতে চাইছে।

‘মির ইয়ার বালুচ’ নামের বিতর্কিত চরিত্র

প্রকল্পের অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে মির ইয়ার বালুচ নামে এক ব্যক্তিকে। তাঁকে বালুচদের ‘প্রখ্যাত লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বালুচ কর্মীদের একটি বড় অংশ দাবি করছে, মির ইয়ার আসলে একটি তৈরি করা ছদ্মচরিত্র, যার পিছনে রয়েছে কোনো রাষ্ট্রীয় এজেন্সি।

২০২৫ সালের মে মাসে মির ইয়ার এক্স (সাবেক টুইটার)–এ একতরফাভাবে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জানান, ছয় কোটি বালুচ ভারতের পাশে আছে। এই ঘোষণার পরপরই তিনি আলোচনায় আসেন, বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়ার হাত ধরে।

তবে বালুচ ন্যাশনাল মুভমেন্টের নেতা নিয়াজ বালুচ ও অন্যান্য পরিচিত কর্মীরা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে ‘ভুয়া অ্যাকাউন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

মেমরি ও পশ্চিমা সহযোগিতার আসল চেহারা

মেমরি এমন এক সংস্থা, যারা আরবি, ফারসি ও তুর্কি মিডিয়ার কিছু নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করে এবং পরে তা মিম বা প্রপাগান্ডা হিসেবে ছড়িয়ে দেয়। শুরু থেকেই ইসরায়েলপন্থী অবস্থান রাখা এই সংস্থা এখন এমন এক ভূখণ্ডে ঢুকেছে, যেখানে বহু জাতিগোষ্ঠীর সংগ্রাম নানা মাত্রায় বিরাজমান।

মোয়াসওয়েসের মতে, মেমরির প্রকল্পটি একদিকে বেলুচিস্তানের ‘উপনিবেশিক শোষণ’ ও বাস্তবতা আড়াল করছে, অন্যদিকে এটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে পশ্চিমা স্বার্থরক্ষাকারী এক অঞ্চল হিসেবে উপস্থাপন করছে। অথচ বাস্তবতা হলো, পশ্চিমা করপোরেশনগুলোর একটি বড় অংশ বহু আগেই বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ লুট এবং পরিবেশ ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ইসরায়েল-ভারত জোট এবং প্রভাব বিস্তারের নতুন পথ

এই প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএসপি প্রকল্প আসলে ভারত ও ইসরায়েলের কৌশলগত জোটের অংশ। ভারত বহু দিন ধরে বেলুচ স্বার্থে কথা বলার চেষ্টা করেছে, যা কাশ্মীরিদের মতো নিজস্ব নিরাষ্ট্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বেলুচদের সংহতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মোয়াসওয়েস মনে করেন, ইসরায়েল যদি বেলুচদের সমর্থন দেয়, সেটি হবে এক ধরনের ‘সংহতির বিভাজন নীতি’। ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য নিরাষ্ট্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যে একতা তৈরি হতে পারত, তা ভেঙে দেওয়ার জন্যই বেলুচিস্তানে ঢুকে পড়ছে ইসরায়েল।

‘বেলুচিস্তান স্টাডিজ প্রজেক্ট’ শুধু একটি গবেষণা প্রকল্প নয়, বরং এটি পশ্চিম এশিয়ার জটিল রাজনীতিতে এক নতুন স্তরের হস্তক্ষেপের সূচনা। ইরান, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন এবং কাশ্মীর—সবগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভূখণ্ড হলেও রাষ্ট্রহীন জাতিগোষ্ঠীর অধিকার প্রশ্নে তাদের লড়াই এক সুতোয় গাঁথা।

এখানে ইসরায়েল ও ভারতের কৌশলগত আগ্রাসন মূলত এই একতাকেই দুর্বল করতে চায়—গবেষক আবদুল্লাহ মোয়াসওয়েস এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছেন। এই প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে ভূরাজনীতির সীমাবদ্ধতা এবং বহিরাগত রাষ্ট্রের প্রভাব নিয়ে আরও গভীর প্রশ্ন তোলা সময়ের দাবি।

Advertisement
Advertisement

আরো পড়ুন  


Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531