ঢাকা,  বৃহস্পতিবার
৩১ জুলাই ২০২৫

Advertisement
Advertisement

টাকা ছাপানো: অর্থনীতির সংকটে সহজ সমাধান না, বরং বিপজ্জনক ফাঁদ

প্রকাশিত: ১৩:২৮, ২৮ জুলাই ২০২৫

টাকা ছাপানো: অর্থনীতির সংকটে সহজ সমাধান না, বরং বিপজ্জনক ফাঁদ

টাকা

টাকা ছাপানো—কেন এত সহজ, অথচ এত কঠিন সিদ্ধান্ত?

অর্থনৈতিক মন্দা, বাজেট ঘাটতি, ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট—এসব পরিস্থিতি যখন চরমে ওঠে, তখন অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগে:

“সরকার টাকা ছাপিয়ে সংকট কেন মেটায় না?”

বস্তুত, টাকা ছাপানো প্রযুক্তিগতভাবে যতটা সহজ, অর্থনীতির বাস্তবতায় তা ততটাই স্পর্শকাতর এবং বিপজ্জনক। কারণ, অর্থনীতির মূল ভিত্তিই হলো "টাকার মূল্য"। আর মুদ্রা সরবরাহ যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেড়ে যায়, তাহলে বাজারে সেই টাকার ক্রয়ক্ষমতা দ্রুত কমে যায়। এর ফলেই জন্ম নেয় মূল্যস্ফীতি—মুদ্রার সবচেয়ে ভয়াবহ শত্রু।


বাংলাদেশে টাকা ছাপানোর সাম্প্রতিক ঘটনা

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই অর্থনীতিতে দেখা দেয় তারল্য সংকট।
সঙ্কটে থাকা ছয়টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপায় বাংলাদেশ ব্যাংক। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত নভেম্বরেই বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

এ সিদ্ধান্ত নিয়ে তখন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকিং বিশ্লেষক, এমনকি রাজনৈতিক মহলেও তীব্র বিতর্ক শুরু হয়।


টাকা ছাপানো হয় আরও কয়েকটি পরিস্থিতিতে

সব টাকা ছাপানোই সমস্যা সৃষ্টি করে না। কিছু পরিস্থিতিতে এটি একেবারে স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয়। যেমন:

১. পুরনো নোট বদলানো:

চলাচলের সময় টাকার নোট নষ্ট হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিতভাবে পুরনো নোট তুলে নিয়ে নতুন নোট বাজারে ছাড়ে।

২. অর্থনীতির বিস্তার:

যখন একটি দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ে, তখন বাজারে লেনদেনের পরিমাণও বাড়ে। ফলে নগদ টাকার চাহিদা মেটাতে কিছুটা নতুন নোট ছাপা জরুরি হয়।

৩. উৎসবকালীন চাহিদা:

ঈদ, পূজা, বৈশাখ ইত্যাদি সময়ে নগদ টাকার প্রয়োজন বেড়ে যায়। অস্থায়ী এই চাহিদা মেটাতে স্বল্প মেয়াদে টাকা ছাপানো হয়।


কিন্তু অতিরিক্ত টাকা ছাপালে কী হয়?

টাকা ছাপানোর ভয়াবহতা বোঝাতে অর্থনীতিতে একটি বিখ্যাত উদাহরণ আছে:

"Too much money chasing too few goods"
অর্থাৎ, যদি বাজারে টাকা অনেক থাকে কিন্তু পণ্য বা সেবা না বাড়ে, তাহলে সেই টাকায় একসময় কিছুই কেনা যায় না।

এই অবস্থার নাম মূল্যস্ফীতি। এবং এর চরম রূপকে বলে হাইপারফ্লেশন


বিশ্বজুড়ে টাকা ছাপানোর ভয়াবহ পরিণতি

জিম্বাবুয়ে (২০০৮):

  • যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিপুল টাকা ছাপে সরকার

  • মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় বছরে ২৩ কোটি ১০ লাখ শতাংশ

  • মানুষ ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে এক পাউরুটি কিনতে যেত

ভেনেজুয়েলা (২০১9):

  • বাজেট ঘাটতি মেটাতে অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপানো হয়

  • মূল্যস্ফীতি একপর্যায়ে ১০,০০০% ছাড়িয়ে যায়

  • সাধারণ মানুষ খাবার ও ওষুধের সংকটে পড়ে

জার্মানি (১৯২৩):

  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে টাকা ছাপানো হয়

  • এক ডজন ডিম কিনতে কোটি কোটি মার্ক দরকার হতো


বাংলাদেশের জন্য সতর্ক সংকেত

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বর্তমানে (২০২৫ সালের মাঝামাঝি) ৯.৩% এর আশপাশে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি:

  • ব্যাংক খাতের ঘাটতি পূরণে নিয়মিতভাবে টাকা ছাপানো হয়

  • উৎপাদন না বাড়ে

  • সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে ব্যর্থ হয়

তাহলে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে দ্বিগুণ বা তারও বেশি হতে পারে, যা নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রায় ভয়াবহ বিপর্যয় নামিয়ে আনবে।


অর্থনীতিবিদদের মতামত

ড. সায়মা হক (ঢাবি, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ):

“টাকা ছাপানো একরকম মাদক। তাৎক্ষণিক স্বস্তি দেয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়। এর বিকল্প হলো—খরচ কমানো, কর আয় বাড়ানো এবং উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া।”

ড. মোইনুল আজাদ (সাবেক ডেপুটি গভর্নর):

“সঙ্কটে টাকা ছাপানো যেতে পারে, তবে সেটা হতে হবে নিয়ন্ত্রিত, স্বল্প মেয়াদি এবং নির্দিষ্ট খাতে।”


সমাধান কী?

  • রাজস্ব আদায়ে দক্ষতা বাড়ানো

  • সরকারি অপচয় কমানো

  • বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন

  • পণ্য উৎপাদনে প্রণোদনা ও ভর্তুকি

  • প্রবৃদ্ধি সুরক্ষা দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ

টাকা ছাপানো যেন ছুরি—যেখানে সার্জারি না হয়ে যদি এলোপাতাড়ি চালানো হয়, তবে তা অর্থনীতিকে কেটে ফেলে।

তাই অর্থনৈতিক সংকটে স্বল্পমেয়াদি সহায়তা হিসেবে টাকা ছাপা হলেও, সেটি হতে হবে স্বচ্ছ, নিয়ন্ত্রিত এবং বিকল্প কৌশলের অংশমাত্র।

অন্যথায় জিম্বাবুয়ে বা ভেনেজুয়েলার পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশও একদিন হাইপারফ্লেশনের খাদে পড়ে যেতে পারে।

Advertisement
Advertisement

আরো পড়ুন  


Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531