ঢাকা,  বৃহস্পতিবার
৩১ জুলাই ২০২৫

Advertisement
Advertisement

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া কেন সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়েছে

প্রকাশিত: ১৯:৩৬, ২৬ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ১৮:৪৭, ২৭ জুলাই ২০২৫

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া কেন সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়েছে

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার শতবর্ষের পুরোনো সীমান্ত বিরোধ নতুন করে ভয়াবহ সামরিক সংঘাতে রূপ নিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সীমান্তবর্তী এলাকায় কম্বোডিয়ার সামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায় থাইল্যান্ড। এর জবাবে রকেট ও কামান হামলা চালিয়েছে কম্বোডিয়া। পাল্টাপাল্টি এই হামলায় উভয় দেশের সেনাদের হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।

দুই দেশই একে অপরকে সংঘাতের সূচনা করার জন্য দায়ী করছে। থাইল্যান্ড দাবি করেছে, কম্বোডিয়া সীমান্তে নতুন করে স্থলমাইন পুঁতে রেখেছে, যার বিস্ফোরণে তাদের পাঁচ সেনা গুরুতর আহত হয়েছেন। অন্যদিকে কম্বোডিয়া বলছে, কোনো উসকানি ছাড়াই থাইল্যান্ড তাদের ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালিয়েছে।

পুরোনো বিরোধে নতুন রক্তক্ষরণ

থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্ত বিরোধের শেকড় শত বছরের বেশি পুরোনো। ফরাসি উপনিবেশিক আমলে, ১৯০৭ সালে প্রথম মানচিত্র তৈরি করে দেওয়া হয়, তখন থেকেই সীমান্তের ৮১৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নানা দখল-সংক্রান্ত বিতর্ক চলে আসছে। এর সঙ্গে বারবার উসকে উঠেছে দুই দেশের জাতীয়তাবাদী আবেগ, রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় অবিশ্বাস।

সর্বশেষ উত্তেজনা শুরু হয় ২০২৫ সালের মে মাসে, যখন সীমান্তের একটি বিতর্কিত এলাকায় দুই দেশের সেনারা মুখোমুখি হয়। কম্বোডিয়ার একজন সেনা নিহত হন। এর পর থেকেই পরিস্থিতি দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জাতীয়তাবাদী আবেগ

কম্বোডিয়ায় প্রায় চার দশক ধরে শাসন করেছেন শক্তিমান স্বৈরশাসক হুন সেন। ২০২৩ সালে তিনি তাঁর ছেলে হুন মানেতকে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও রাজনীতিতে এখনো প্রবলভাবে প্রভাবশালী। বিশ্লেষকরা মনে করেন, হুন সেন তাঁর ছেলের রাজনৈতিক অবস্থান দৃঢ় করতে জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে দিচ্ছেন।

অন্যদিকে থাইল্যান্ডও রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা বর্তমানে দায়িত্ব থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত। তাঁর বিরুদ্ধে সীমান্ত সংকট মোকাবিলায় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। তাঁর কম্বোডিয়ান সাবেক নেতা হুন সেনের সঙ্গে ফাঁস হওয়া ফোনালাপ তাকে আরও চাপে ফেলেছে। ফোনে হুন সেনকে ‘আংকেল’ সম্বোধন করে দেওয়া কিছু বক্তব্য সমালোচিত হয়েছে, যেখানে তিনি থাইল্যান্ডের এক জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও নেতিবাচক মন্তব্য করেন।

বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি

সংঘাত শুরুর পর দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক নিষেধাজ্ঞার পালা চলছে। থাইল্যান্ড সীমান্ত পারাপারে কঠোরতা আরোপ করেছে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে কম্বোডিয়া থাইল্যান্ড থেকে ফল, সবজি আমদানি বন্ধ করেছে, থাই সিনেমা সম্প্রচার স্থগিত করেছে এবং ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ কমিয়ে দিয়েছে।

এ ছাড়া দুই দেশই কূটনৈতিকভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। থাইল্যান্ড কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে নিজ রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। জবাবে কম্বোডিয়া ব্যাংককে অবস্থিত দূতাবাস থেকে সব কর্মীকে সরিয়ে নিয়েছে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে।

আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া

কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “থাইল্যান্ড সম্পূর্ণ অকারণে আমাদের ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালিয়েছে। এটি শান্তি ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল।”

থাইল্যান্ডের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচাইয়াচাই বলেন, “আলোচনা শুরু করার আগে অবশ্যই সব ধরনের সামরিক সংঘাত বন্ধ করতে হবে। এখনো পর্যন্ত যুদ্ধ ঘোষণা হয়নি, এবং সংঘাত সীমিত কিছু এলাকায় সীমাবদ্ধ রয়েছে।”

আঞ্চলিক জোট আসিয়ানের চেয়ারম্যান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম দুই দেশকে শান্ত থাকার আহ্বান জানালেও বিশ্লেষকরা বলছেন, আসিয়ানের মধ্যস্থতার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ, সংস্থাটির দীর্ঘদিনের নীতি হলো অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা।

বিশ্লেষক তিতা সাংলি বলেন, “চীনই একমাত্র বাইরের শক্তি যাদের উভয় দেশের ওপর সরাসরি প্রভাব রয়েছে। কিন্তু বেইজিংকে অনেকেই কম্বোডিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে দেখে, যা থাইল্যান্ডের জন্য অস্বস্তিকর।”

অর্থনৈতিক সংকট থেকে মনোযোগ সরানোর কৌশল?

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, দুই দেশের সরকার হয়তো অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট থেকে জনমত সরাতেই সীমান্ত উত্তেজনাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কারণ, ১ আগস্ট থেকে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড উভয় দেশই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৩৬ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত তাদের রপ্তানি খাতে বড় ধাক্কা দিতে পারে।

বর্তমানে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে যে উত্তেজনা চলছে, তা শুধু সীমান্ত দখল নয়—বরং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সংকটের সমন্বিত বহিঃপ্রকাশ। শান্তিপূর্ণ সমাধান পেতে হলে আন্তর্জাতিক চাপ, সংলাপ এবং নিরপেক্ষ মধ্যস্থতা অত্যন্ত জরুরি। এখন দেখার বিষয়, এই সংঘাত সীমিত পর্যায়ে থেমে থাকে, নাকি তা আরও বিস্তৃত হয়ে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে।

Advertisement
Advertisement

আরো পড়ুন  


Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531