
মাহেরীন
ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সোমবারের (২১ জুলাই) দুপুরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন সাহসী শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী। আগুন আর আতঙ্কে যখন চারদিকে হাহাকার, তখন তিনি জীবন বাজি রেখে রক্ষা করেন অন্তত ২০ শিক্ষার্থীর জীবন। নিজের প্রাণ দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন মানবিকতা, সাহসিকতা আর দায়িত্ববোধের প্রতীক।
ঘটনার বিবরণ
সোমবার দুপুরে ক্লাস চলাকালে মাইলস্টোন স্কুলের পাশের একটি ভবনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। মুহূর্তেই ভবনে আগুন ধরে যায়। ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করে। কিন্তু ঠিক তখনই নিজেদের জীবন বাঁচাতে দৌড় না দিয়ে, শিশু শিক্ষার্থীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মাহেরীন একের পর এক শিশু শিক্ষার্থীকে বের করে আনেন, আবার ফিরে যান বাকি বাচ্চাদের উদ্ধারে। সেই শেষ ফেরাটা আর ফেরা হয়নি। আগুনের লেলিহান শিখায় নিজেই আটকে পড়েন তিনি। তার শরীরের অধিকাংশই দগ্ধ হয়।
তাৎক্ষণিকভাবে তাকে গুরুতর অবস্থায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। সেখানেই রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মানবিক শিক্ষিকা।
কে ছিলেন মাহেরীন চৌধুরী?
নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ি গ্রামের মেয়ে মাহেরীন চৌধুরী ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ও মানবিক গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের নির্বাহী কমিটির সভাপতি। পরিবারেও তিনি ছিলেন পরিচিত এক উদার মুখ। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাতিজি মাহেরীন ছিলেন মহিতুর রহমান চৌধুরী ও সাবেরা চৌধুরীর মেয়ে। তার দাদি রওশানারা চৌধুরী ছিলেন জিয়াউর রহমানের খালা।
শিক্ষকতা শুধু তার পেশা ছিল না—তা ছিল তার জীবনের আদর্শ। ঢাকায় থেকে তিনি নিয়মিত গ্রামের শিক্ষার্থীদের বই-খাতা কিনে দিতেন, সমাজসেবায় অংশ নিতেন। তার মানবিকতা ও দায়বদ্ধতা তাকে করে তুলেছিল এলাকার আদর্শ শিক্ষিকা।
“যাদের বাঁচিয়েছি, তারাও তো আমার সন্তান”
শেষ সময়ে হাসপাতালের বিছানায় স্বামী মনসুর হেলালের হাত ধরে বলেছিলেন মাহেরীন—
“তুমি আমার সঙ্গে আর দেখা পাবে না... কিন্তু যাদের বাঁচিয়েছি, তারাও তো আমার সন্তান। আমি তাদের একা রেখে আসতে পারিনি।”
মনসুর হেলাল বলেন, “ও আমার দুই সন্তানের কথা ভেবে কিছুক্ষণও থামেনি। আগুনের ভিতরে ঢুকে একে একে বাচ্চাদের বের করে আনছিল। নিজে আটকা পড়ার পরও হতাশ হয়নি। ও ছিল মায়ের মতো—সবার জন্য, নিজের সন্তানদের জন্যও।”
শেষ বিদায়
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বিকেল ৪টায় মাহেরীনের গ্রামের স্কুল প্রাঙ্গণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে তাকে দাফন করা হয় বাবা-মায়ের কবরের পাশে। জানাজায় অংশ নেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, রাজনীতিক, সমাজকর্মী ও গ্রামবাসী।
তার চাচা রিকো চৌধুরী বলেন, “ছোটবেলা থেকেই ও খুব মেধাবী ছিল। ঢাকায় থেকেও গ্রামের কারও বিপদে দূরে থাকত না।”
সোনালী ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা মোস্তফা আজাদ বলেন, “আমরা একজন আদর্শ মানুষকে হারালাম। সে শুধু শিক্ষক ছিল না, সে ছিল সমাজের আলোকবর্তিকা।”
বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মহুবার রহমান বলেন,
“তিনি শুধু একজন শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন মানবিক বীর। শিক্ষক সমাজ তার আত্মত্যাগে শোকাহত, তবে গর্বিতও।”
জাতির প্রতি এক অনন্য দৃষ্টান্ত
মাহেরীন চৌধুরীর এই আত্মত্যাগ নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে দিল, দায়িত্ববোধ কাকে বলে, ভালোবাসা কেমন হতে হয়, আর একজন শিক্ষকের ভূমিকা কত গভীর হতে পারে।
আজ তিনি নেই, কিন্তু তার এই আত্মত্যাগ থাকবে ইতিহাসের পাতায়, থাকবে ছাত্রছাত্রীদের হৃদয়ে। এই দেশ মাহেরীনের মতো সাহসী, মানবিক শিক্ষিকাকে মনে রাখবে চিরদিন।