
ক্যাশলেস
একটি ব্যক্তিগত গল্প দিয়ে শুরু
গত জুনের এক সকালে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সানজিদ ইমরান। পকেটের শেষ টাকাটুকুও খরচ করে নির্ভার মনে বাসে উঠেছিলেন তিনি। কারণ—“ঢাকায় এসে প্রয়োজনে টাকা তুলে নেব বা ডিজিটাল পেমেন্টেই সব চলবে।” কিন্তু মাঝপথে বিরতিতে এক গ্লাস পানি কিংবা নাস্তার জন্য যখন কোনো বিকাশ/নগদ এজেন্ট, কিউআর কোড বা এটিএম পাওয়া গেল না, তখন বুঝলেন—ডিজিটাল স্বপ্ন আর বাস্তবতা এখনও বহু দূরের পথ।
এই ঘটনা শুধু এক সানজিদের নয়—এটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের ডিজিটাল পেমেন্ট রূপান্তরের বাধাগ্রস্ত বাস্তবতার।
উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য, ধীর গতি
২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিয়েছিল—
“২০২৭ সালের মধ্যে দেশের ৭৫% লেনদেন হবে ডিজিটাল মাধ্যমে।”
কিন্তু ২০২৫ সালের মাঝামাঝিতে এসে লক্ষ্যটি ক্রমেই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যেসব উদ্যোগ এসেছিল পরিবর্তনের আশায়
১️⃣ ‘বিনিময়’ (২০২২):
-
লক্ষ্য ছিল মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস ও ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইউপিআই-এর মতো ইন্টিগ্রেটেড পেমেন্ট সিস্টেম গড়ে তোলা
-
কিন্তু ব্যাংকগুলোর অনীহা, প্রচারণার অভাব, ও গ্রাহকের অজ্ঞতা প্রকল্পটিকে ব্যর্থতায় ডুবিয়েছে
-
২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর প্রকল্পটি স্থগিত করা হয়
২️⃣ ‘বাংলা কিউআর’ (২০২৩):
-
সব ব্যাংক ও মোবাইল প্ল্যাটফর্মে একীভূত QR পেমেন্ট সিস্টেম চালুর লক্ষ্য
-
কিন্তু আজও অধিকাংশ দোকানে এটি অনুপস্থিত
-
কারণ: অনেক ব্যাংকেরই নেই প্রয়োজনীয় ডিজিটাল অবকাঠামো
‘টাকাপে’ (২০২৩):
-
দেশের প্রথম ডোমেস্টিক ডেবিট কার্ড
-
ভিসা-মাস্টারকার্ডের নির্ভরতা কমাতে চালু হলেও মাত্র ৮টি ব্যাংক এটি অফার করে
বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান ও স্বীকারোক্তি
নতুন কোনো উদ্যোগ না আসায় বাংলাদেশ ব্যাংক ‘বিনিময়’-এর বিকল্প আন্তঃপরিচালনযোগ্য প্ল্যাটফর্মে কাজ শুরু করেছে, গেটস ফাউন্ডেশন ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মোজালুপ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায়।
ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হুসেইন খান স্বীকার করেছেন:
“লক্ষ্য করেছি, নগদহীন লেনদেন থেমে আছে। আমরা আগামী ছয় মাসে বাংলা কিউআর বাধ্যতামূলক করতে চাই।”
তিনি আরও বলেন,
“টাকা ছাপানো, পরিবহন ও সংরক্ষণে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। ডিজিটাল লেনদেন ছাড়া বিকল্প নেই।”
কেন ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থায় আগ্রহ কম?
ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিকোণ:
-
ডিজিটাল লেনদেনে ভ্যাট ও কর দিতে হয়
-
নগদ লেনদেনে নজরদারির ভয় কম
-
তাই দোকানদাররা এখনো ক্যাশেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন
ব্যাংকের দৃষ্টিকোণ:
-
প্রণোদনার অভাব, যেমন করছাড় বা ক্যাশব্যাক নেই
-
নীতিগত বাধ্যবাধকতা না থাকলে কেউ QR কোড বা ই-পেমেন্ট চালাতে চায় না
ব্যবহারকারীর দৃষ্টিকোণ:
-
বয়স্ক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখনও ডিজিটাল লেনদেনে অনভ্যস্ত
-
যেমন—ঝর্ণা পারভীন, গাজীপুরের এক মা, বলেন:
“বিকাশে টাকা আসে, কিন্তু কেনাকাটায় ব্যবহার করতে ভয় পাই। হারালে তো গেল!”
ডিজিটাল লেনদেনের কিছু পরিসংখ্যান (মে ২০২৫):
খাত | লেনদেনের পরিমাণ (কোটি টাকা) |
---|---|
এমএফএস ক্যাশ-আউট | ৪৪,৩৫৫ |
মার্চেন্ট পেমেন্ট | ৭,৪৩৩ |
ইউটিলিটি বিল | ৩,৩৭২ |
সরকার থেকে ব্যক্তি (G2P) | ৬৫৫ |