
‘মাইটি ড্রাগন
চীনা প্রবাদ বলে—‘যে উচ্চতা দখল করে, সেই জয়ী হয়।’ আধুনিক যুদ্ধকৌশলে এই কথাটিই যেন বাস্তবতা হয়ে উঠছে চীনের জন্য। আর এই উচ্চতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতীক হয়ে উঠেছে চীনের অত্যাধুনিক স্টেলথ যুদ্ধবিমান জে-২০, যাকে দেশটির রাষ্ট্রীয় মিডিয়া বলছে—‘মাইটি ড্রাগন’।
সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল সিসিটিভি জানিয়েছে, পূর্ব চীন সাগরে দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চলের (ADIZ) কাছাকাছি আসা একটি বিদেশি যুদ্ধবিমান—সম্ভবত মার্কিন F-35—কে প্রতিহত করেছে জে-২০। যদিও পশ্চিমা গণমাধ্যমে এ নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি, চীনের নিজস্ব সামাজিক মাধ্যমগুলোতে (#J20PilotSaysWeCantRetreat হ্যাশট্যাগে) খবরটি কয়েক কোটি ভিউ অর্জন করেছে।
চীনের দৃষ্টিতে, জে-২০ কেবল একটি যুদ্ধবিমান নয়—এটি প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা, জাতীয় আত্মবিশ্বাস ও ভবিষ্যতের যুদ্ধে নেতৃত্বের প্রতীক। এখন এই স্টেলথ ফাইটারে ব্যবহৃত হচ্ছে চীনের তৈরি নিজস্ব ইঞ্জিন, যা রাশিয়ান প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। চীনের দাবি, জে-২০-এর উৎপাদন এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে ভবিষ্যতে এটি যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫-এর সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
জে-২০: আধুনিক যুদ্ধের নতুন সংজ্ঞা
জে-২০-এর শক্তিমত্তা এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা সম্পর্কে চীনের মিডিয়া একাধিক তথ্য তুলে ধরেছে—
-
শত্রু বিমান থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে থেকেও রাডারে অদৃশ্য থাকতে সক্ষম।
-
মাত্র ৮ মিনিটে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।
-
‘সাপের মতো বেঁকে উড়ান’ দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে, যা রাডার ও লক্ষ্যবস্তুকে বিভ্রান্ত করে।
-
জে-১৬ডি ইলেকট্রনিক যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য ড্রোনের সহযোগিতায় এটি আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
চীন এমনকি দুই আসনবিশিষ্ট জে-২০ যুদ্ধবিমানেরও পরীক্ষা চালাচ্ছে, যেখানে ভবিষ্যতে মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ড্রোন একসঙ্গে লড়াই করতে পারবে।
প্রযুক্তি, তরুণ পাইলট ও জাতীয়তাবাদ
জে-২০ কেবল প্রযুক্তির গল্প নয়, এর পেছনে আছে চীনের তরুণ, দক্ষ ও উচ্চআদর্শে বিশ্বাসী পাইলটদের একটি শক্তিশালী বাহিনী। গড় বয়স মাত্র ২৮ বছর, তারা শুধু উড়তে জানে না, বরং যুদ্ধের দার্শনিকতা নিয়েও গর্বিত।
চীনের সামরিক বিশ্লেষক ওয়াং শিয়াংশুই বলেন, “চীন এখন সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ আধিপত্য’-এর কৌশল নিচ্ছে—অর্থাৎ কম খরচে বেশি লাভ, স্টেলথ, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ এবং কৌশলী নড়াচড়া দিয়েই প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা।”
ড্রোন শক্তি: উঝেন সিরিজের উত্থান
জে-২০-এর পাশাপাশি চীনের যুদ্ধ প্রস্তুতির বড় অংশজুড়ে রয়েছে তাদের হাইপারসনিক ও স্টেলথ ড্রোন—উঝেন-৭ ও উঝেন-৮। এই ড্রোনগুলো:
-
২০,০০০ থেকে ৫০,০০০ মিটার উচ্চতায় উড়তে সক্ষম
-
ম্যাচ ৭ গতিতে চলতে পারে
-
স্টেলথ প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শত্রুর রাডার ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ড্রোনগুলো জাপান, ভারত ও তাইওয়ান-এর আকাশ প্রতিরক্ষার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে।
বার্তা স্পষ্ট: আকাশে আধিপত্যই চূড়ান্ত লক্ষ্য
জে-২০ এখন চীনের জন্য শুধু একটি যুদ্ধবিমান নয়—এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক বার্তা। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত বা তাইওয়ান—সবাইকে উদ্দেশ করে চীন বলছে:
“এই আকাশ আমাদের। এবং আমরা এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করব—প্রয়োজনে সংঘর্ষের প্রস্তুতি নিয়েই।”
চীনের রাষ্ট্রীয় প্রচারে জে-২০-এর উন্নয়ন, সফল মিশন ও প্রতিক্রিয়া তীব্র আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তুলে ধরা হচ্ছে। প্রতিটি উড়ান, প্রতিটি স্ক্র্যাম্বল যেন বলে দিচ্ছে—‘আমরা প্রস্তুত, এবং আমরা পিছু হটব না।’
উপসংহার:
জে-২০ এখন শুধু একটি বিমান নয়—একটি প্রতীক। এটি চীনের ‘জাতীয় পুনরুত্থান’, ‘প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব’ ও ‘ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্বের’ ঘোষণাপত্র। বিশ্ব শোনছে, হয়তো অনেকে ভীত, কেউ কেউ প্রস্তুত হচ্ছে, কিন্তু চীন জানিয়ে দিচ্ছে—এই আকাশ, এই উচ্চতা, এখন তাদের দখলে।