
ফ্ল্যাট
গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের বিলাসবহুল আবাসন খাতে দেখা দিয়েছে নজিরবিহীন ধস। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমূল্যের অ্যাপার্টমেন্টে বিনিয়োগ করে আসা প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী ও আমলাদের একটি বড় অংশ এখন দেশত্যাগী, আত্মগোপনে অথবা আইনি জটিলতায় পড়ায় এই খাতটি প্রায় অচলাবস্থার মুখে পড়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিকদের কারণে স্থগিত বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের চুক্তি
ঢাকার অভিজাত এলাকায়—বিশেষ করে গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা এবং ধানমন্ডিতে—বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল প্রকল্পে সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও দলীয় ঘনিষ্ঠদের জন্য সংরক্ষিত ফ্ল্যাটের বুকিং বাতিল হয়ে গেছে।
বারিধারার ৭ নম্বর রোডে একটি ছয়তলা বিলাসবহুল প্রকল্পে সাবেক এক সংসদ সদস্য ১৭ কোটি টাকায় তৃতীয় তলার ২,৯০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট বুক করলেও, সরকার পরিবর্তনের পর আত্মগোপনে চলে যান এবং চুক্তি বাতিল করেন।
তিনি ছয় কিস্তির পর আর টাকা না দিয়ে অর্থ ফেরতের আবেদন করেন। পরবর্তীতে তাকে কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান প্রকল্প তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মারুফুর রহমান।
বিলাসবহুল ইউনিট বিক্রি না হওয়ায় ডেভেলপাররা চাপে
উক্ত প্রকল্পের ছয়টি ইউনিটের মধ্যে তিনটি বুক করেছিলেন দুই সাবেক এমপি ও এক সাবেক হুইপ, যারা প্রত্যেকেই পরবর্তীতে চুক্তি বাতিল করেন। এখন কোম্পানি এই ইউনিটগুলো পুনরায় বিক্রির চেষ্টা করছে।
২৬ এপ্রিল প্রকল্পস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, ভবনের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হলেও অভ্যন্তরীণ কিছু কাজ বাকি রয়েছে। প্রতিটি ইউনিটে রয়েছে আমদানি করা ওক কাঠের দরজা, ইতালীয় মার্বেল ফ্লোরিং, সুইজারল্যান্ড থেকে আনা রিমোট-চালিত ছাতা ও ছাদে সুইমিং পুলসহ নানা বিলাসবহুল সুবিধা।
চরম ধস বিক্রয় পরিসংখ্যানে
গুলশান সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৬ কোটি থেকে ২১ কোটি টাকার মধ্যে ৭২৮টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট নিবন্ধিত হলেও, আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছে মাত্র ৩৯টি ইউনিট।
২০২৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত মাত্র ২১টি চুক্তি সই হয়, যার মধ্যে গুলশানে মাত্র ছয়টি ইউনিট।
জাতীয় নিবন্ধন অধিদপ্তর জানায়, ২০২৩ সালে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিত করছে এই হার এবার ১০ হাজার কোটির নিচে নেমে যেতে পারে।
বিনিয়োগে নাটকীয় পতন
একাধিক রিয়েল এস্টেট কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অপ্রকাশিত অর্থ এবং রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত বিনিয়োগকারীরাই এতদিন এই খাতে মূল চালিকাশক্তি ছিলেন। এখন সেই অর্থের প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় ডেভেলপাররা নতুন প্রকল্প শুরিতে আগ্রহ হারিয়েছেন।
র্যাংগস প্রপার্টিজ, শান্তা হোল্ডিংস, সাউথব্রিজ, কনকর্ড, বিটিআই, নাভানা, শেলটেকসহ প্রায় সব শীর্ষ ডেভেলপারই নতুন প্রকল্প স্থগিত রেখেছে।
মধ্যবিত্ত খাতেও সংকট
রিহ্যাব সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান জানান, শুধু বিলাসবহুল নয়, মধ্যবিত্ত ও সাধারণ ইউনিট বিক্রিও ব্যাহত হচ্ছে।
বর্তমানে ঢাকাজুড়ে প্রায় ২ হাজার সাধারণ এবং ১০০টি বিলাসবহুল ইউনিট এখনো বিক্রি হয়নি, যা ডেভেলপারদের ওপর আর্থিক চাপ বাড়িয়েছে।
ক্রেতারা পিছিয়ে, বিক্রেতারা দিশেহারা
২০২৪ সালের জুনে ঢাকা-২০ আসনের তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদ বসুন্ধরায় একটি ছয়তলা বাড়ি কিনতে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন। অগ্রিম ৫০ লাখ টাকাও দেন। কিন্তু আগস্টের পর তিনি চুক্তি বাতিল করেন এবং অগ্রিম টাকার ৯০ শতাংশ ফেরতের দাবি জানান।
একই ধরনের ঘটনা ঘটে বসুন্ধরা রিভারভিউ এলাকায়, যেখানে এক আওয়ামী লীগ নেতা ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকায় চুক্তি করার পর ৫ আগস্টের পর থেকে নিখোঁজ। দলিল সম্পন্ন হয়ে যাওয়ায় এখন ওই সম্পত্তি আবার বিক্রি করাও সম্ভব হচ্ছে না।
সরকারের হস্তক্ষেপ সীমিত
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলেন, বিলাসবহুল খাতে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে না যতক্ষণ না কেউ বৈধ আয় ব্যয়ের বাইরে যাচ্ছে।
রিহ্যাবের সাবেক পরিচালক নাইমুল হাসান বলেন, রিয়েল এস্টেট খাতে অপ্রকাশিত অর্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত, এখন সেই উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খাতটি স্থবির হয়ে গেছে। তিনি এনবিআরের কাছে পুনরায় বিনিয়োগে কর সুবিধার দাবি জানান।
বাংলাদেশের আবাসন খাত, বিশেষত বিলাসবহুল সেগমেন্ট, বর্তমানে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগ হ্রাস, ও আর্থিক জটিলতায় এই খাতের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকার চাইলে কর নীতিতে নমনীয়তা ও আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে খাতটি কিছুটা হলেও স্থিতিশীল করতে পারে।