
নিপীড়ন আরও নির্মম,
১৮ জুলাইয়ের ভয়াবহ সংঘর্ষ ও প্রাণহানির রেশ কাটতে না কাটতেই ১৯ জুলাই শুক্রবার দেশজুড়ে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সর্বাত্মক অবরোধের দ্বিতীয় দিনটি রূপ নেয় এক ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সহিংসতায়। দিনব্যাপী সংঘর্ষ, গুলি, অগ্নিসংযোগ, সরকারি স্থাপনায় হামলা, হাসপাতালের সামনে মৃতদেহের সারি, কারাগার দখল এবং সন্ধ্যার পর কারফিউ—বাংলাদেশ এমন এক দিন প্রত্যক্ষ করল, যা স্মরণ করাবে এক জাতীয় সংকটের ইতিহাস।
গুলিতে আহতদের ঢল, হাসপাতালগুলোতে ভিড়
১৯ জুলাই সকাল থেকেই ঢাকার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অ্যাম্বুলেন্সে করে আসতে থাকে গুলিবিদ্ধ মানুষ। নারী, শিশু, বৃদ্ধ—কোনো বয়সী বাদ যায়নি। অনেকে এসেছেন রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করেও। চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, বেশিরভাগের শরীরে গুলি লেগেছে বুকে, পিঠে ও মাথায়।
সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে সরকার-সমর্থকদের বাধার মুখে পড়েন অনেকেই। একাধিক হাসপাতালে গুলিবিদ্ধদের চিকিৎসা না দেওয়ার অভিযোগও উঠে।
মিরপুরে বাসায় গুলি, ১১ বছরের শিশুর মৃত্যু
মিরপুরের সাফুরা আবাসিক এলাকায় একটি বাসার জানালা দিয়ে ঢুকে গুলি লাগে ১১ বছরের শিশু সাফকাত সামিরের বুকে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সেদিন পুরো মিরপুর ছিল যেন যুদ্ধক্ষেত্র। আকাশে উড়তে দেখা যায় র্যাবের হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টার থেকে ফেলা হয় সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস, এমনকি গুলির অভিযোগও আসে।
সামিরের লাশের ময়নাতদন্তে বাধা দেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা মো. ইসমাইল হোসেন। পরিবারটি পরে বাধ্য হয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করে।
সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা কার্যত ছিল অচল। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল স্টেশন, বিআরটিএ ভবন, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বেশ কয়েকটি সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ঘটে একই ধরনের ঘটনা। নরসিংদী, বগুড়া, খুলনা, বরিশালসহ অন্তত ৩০টি জেলায় বড় ধরনের সহিংসতার খবর পাওয়া যায়।
নরসিংদী কারাগার দখল, কয়েদি পালিয়ে যায়
বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নরসিংদী জেলা কারাগারে আক্রমণ চালায় বিক্ষোভকারীরা। কারারক্ষীরা নিয়ন্ত্রণ হারালে অন্তত কয়েক শতাধিক কয়েদি পালিয়ে যায়। একইসঙ্গে বিক্ষোভকারীরা হামলা চালায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং জেলা পরিষদ ভবনে।
সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের বহরে হামলা, নিহত পিএস
গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বহরে হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। রাজধানীর উত্তরা আজমপুর এলাকায় তার গাড়িতে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। ঘটনাস্থলে তার ব্যক্তিগত সহকারী আতিকুর রহমান নিহত হন এবং জাহাঙ্গীরসহ তার গানম্যান গুরুতর আহত হন।
ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ ও সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত
দিনব্যাপী সহিংসতার পর রাত ১২টা থেকে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করা হয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সব জেলা শহরে সেনা মোতায়েনের নির্দেশনা পৌঁছে যায় রাতেই।
ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, “কোটা সংস্কারের নামে কিছু বিশৃঙ্খল গোষ্ঠী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে পড়েছে। জনজীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই সমাবেশ নিষিদ্ধ ও কারফিউ জারি করা হয়েছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুলিশের ওয়েবসাইট হ্যাক
দুপুরে হ্যাকার গোষ্ঠী ‘দ্য রেজিসটেন্স’ বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুলিশ সদরদপ্তরের ওয়েবসাইট হ্যাক করে। সেখানে কালো ব্যানারে ‘শিক্ষার্থী হত্যা বন্ধ করুন’ বার্তা প্রকাশ করা হয়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সাইবার প্রতিবাদের প্রকাশ।
রামপুরা থানায় ঘেরাও ও সংঘর্ষ
বিকেলে আন্দোলনকারীরা রামপুরা থানা ঘেরাও করে। পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত হন অনেকে। মোটরসাইকেলে আগুন, পুলিশ ভ্যানে ভাঙচুর এবং কাঁদানে গ্যাস, গুলি ছোড়ার মাধ্যমে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
জাতিসংঘের হিসাব: একদিনে ৩০০ নিহত
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের এক জরুরি প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯ জুলাই একদিনেই ঢাকাসহ দেশব্যাপী সহিংসতায় প্রায় ৩০০ জন নিহত হন। সংস্থাটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলি ও নিষ্ঠুর দমননীতিকে “মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন” বলে উল্লেখ করেছে।
শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা, নয় দফা দাবি
রাতের মধ্যেই পদ্মা রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় সরকারের তিন মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। বৈঠকে ব্যর্থতা ও সংলাপের স্থবিরতার প্রেক্ষিতে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে নয় দফা দাবি পেশ করে ‘শাটডাউন’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
নয় দফার মূল দাবি:
-
শেখ হাসিনার প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া,
-
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেতুমন্ত্রীর পদত্যাগ,
-
গুলিবর্ষণ ও হামলায় জড়িতদের বিচার,
-
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ ও ছাত্র সংসদ পুনরুজ্জীবন,
-
নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ।
১৯ জুলাইয়ের ঘটনা কেবল একটি ছাত্র আন্দোলনের মোড় পরিবর্তনের দিন নয়—এটি হয়ে উঠেছে এক জাতীয় অভ্যুত্থান ও রাষ্ট্রীয় সঙ্কটের প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও আন্দোলনের ধরণ স্পষ্ট করে দেয়, বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গুরুতর ফাটল ধরেছে। এখন দেখার বিষয়, সরকার আদৌ এই সংকট মোকাবেলায় গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে হাঁটবে কিনা—না হলে আগামী দিনগুলোতে আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকে যেতে পারে গোটা দেশ।