
বিদ্যুৎ লাইন
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত বছরের পর বছর লোকসানে ডুবে থাকলেও সরকারের ভর্তুকি দিয়ে খাতটিকে সচল রাখা হচ্ছে। গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ ৬২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এর মধ্যেও সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো নিয়মিত মুনাফা করছে এবং সেই মুনাফা থেকে কর্মকর্তা–কর্মচারীরা পাচ্ছেন মোটা অঙ্কের প্রফিট বোনাস।
কেন লোকসান, অথচ মুনাফা?
-
পিডিবির লোকসান:
-
প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির খরচ হয় গড়ে ১১ টাকা।
-
বিতরণ সংস্থাগুলোর কাছে তারা তা বিক্রি করে মাত্র ৭ টাকা ৪ পয়সায়।
-
ফলে বিপুল ঘাটতি মেটাতে হয় সরকারি ভর্তুকি দিয়ে।
-
-
কোম্পানির কৃত্রিম মুনাফা:
-
বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন করুক বা না করুক।
-
এতে উৎপাদন না করেও অনেক কেন্দ্র আয় দেখাতে পারে।
-
সেই আয়কে মুনাফা ধরে রাখা হয়, যদিও প্রকৃতপক্ষে এটি ভর্তুকির অর্থ থেকে আসা।
-
ভর্তুকি ও বেতন কাঠামো
বিদ্যুৎ খাতে আছে ৬টি উৎপাদন, ৬টি বিতরণ ও ১টি সঞ্চালন কোম্পানি।
-
এসব কোম্পানির বেতন সরকারি স্কেলের চেয়ে অনেক বেশি।
-
কর্মকর্তা–কর্মচারীরা প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, ইনস্যুরেন্স, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি ও ছুটি–সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান।
-
এর বাইরেও প্রতিবছর তাঁরা প্রফিট বোনাস ভাগাভাগি করেন।
শ্রম আইনের সুযোগ
-
শ্রম আইন অনুযায়ী, কোম্পানির নিট মুনাফার ৫% যায় ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডে (ডব্লিউপিপিএফ)।
-
এর মধ্যে:
-
৮০% কর্মচারীদের জন্য,
-
১০% কল্যাণ তহবিলে,
-
১০% শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে।
-
-
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিবছর গড়ে কয়েক লাখ টাকা প্রফিট বোনাস পান।
সরকারের নিষেধাজ্ঞা ও বাস্তবতা
-
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুৎ বিভাগ মুনাফা ভাগাভাগি বন্ধে নির্দেশনা দেয়।
-
কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মুনাফা ভাগ করেছে:
-
ইজিসিবি (Electricity Generation Company of Bangladesh) → ১৬.৭৭ কোটি টাকা
-
এপিএসসিএল (Ashuganj Power Station Company Limited) → ২৬.৮১ কোটি টাকা
-
নওপাজেকো (NWPGCL) → ৩৭ কোটি টাকা
-
আরপিসিএল (RPCL) → ৯.৮৪ কোটি টাকা
-
বিআরপিএল (BR Powergen) → ৫.৬২ কোটি টাকা
-
-
কোম্পানির কর্মকর্তাদের যুক্তি, শ্রম আইন মানা তাঁদের বাধ্যবাধকতা।
যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোতে জটিলতা
-
পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র (BCPCL):
-
প্রথম বছরে মুনাফা ভাগাভাগি হলেও পরের বছরগুলোতে চীনা অংশীদার আপত্তি জানায়।
-
তাঁদের যুক্তি—ঋণ পরিশোধের আগে মুনাফা বিতরণ সম্ভব নয়।
-
এখনো বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন।
-
-
রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র (BIFPCL):
-
বাংলাদেশি অংশ (পিডিবি) সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী মুনাফা ভাগাভাগি বন্ধে মত দিয়েছে।
-
বিশেষজ্ঞদের মত
-
নীতিগতভাবে সরকারি কোম্পানির লাভ করার কথা নয়।
-
সেবা দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য, অথচ তারা ভর্তুকি খেয়ে মুনাফা দেখাচ্ছে।
-
বেতন সরকারি বেতন স্কেলের চেয়ে দেড় গুণ বেশি হওয়ার পরও কর্মকর্তারা শত শত কোটি টাকা ভাগ পাচ্ছেন।
-
ভোক্তা সংগঠন ক্যাব বলছে—
-
তাঁরা প্রকৃত শ্রমিক নন, তবুও শ্রম আইনের সুযোগ নিচ্ছেন।
-
মুনাফার ভাগ নিলে লোকসানের দায়ও নিতে হবে।
-
আসলে এটি “মুনাফার নামে লুণ্ঠন”।
-
বিদ্যুৎ খাত আসলে লোকসানে ডুবে আছে, আর সেই লোকসান মেটাতে সরকার প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। অথচ সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো আইন ও কাঠামোর ফাঁক ব্যবহার করে কৃত্রিম মুনাফা দেখাচ্ছে এবং তা থেকে মোটা অঙ্কের প্রফিট বোনাস ভাগাভাগি করছে। সরকার যদিও মুনাফা ভাগাভাগি বন্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে, বাস্তবে শ্রম আইনের বাধ্যবাধকতা দেখিয়ে এই প্রথা এখনো চালু রয়েছে।