
২২ বস্তিতে মাদকের আখড়া, পেছনে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশ
গাজীপুরের টঙ্গী বাজারসংলগ্ন হাজী মাজার বস্তি এখন মাদকের সবচেয়ে বড় আখড়া হিসেবে পরিচিত। বাঁশ ও টিনের তৈরি ছোট ছোট ঘরগুলোতে প্রকাশ্যে চলছে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকের বেচাকেনা। শুধু হাজী মাজার বস্তি নয়, গাজীপুর মহানগরের ২২টি বস্তি এখন মাদকের বড় বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশের বিভিন্ন সূত্র জানায়, মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা বা চাঁদা নেয় পুলিশ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। পুলিশের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে এ তথ্যও উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন থানার ওসি মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায় করেন, যার একটি অংশ যায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পকেটে।
ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণকারী রাজনৈতিক চক্রও বদলেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে এ কারবার নিয়ন্ত্রণ করতেন তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের চাচার অনুসারীরা। ক্ষমতা পরিবর্তনের পর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতার হাতে। তবে এসব অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নেতারা অস্বীকার করেছেন।
মাদক আখড়াগুলোতে বহিরাগতদের প্রবেশ সহজ নয়। টঙ্গীর হাজী মাজার বস্তিতে সাংবাদিকরা গেলে তাদের ঘিরে ধরা হয়, জেরা করা হয় এবং আক্রমণাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। তাদের মোবাইল ফোন পরীক্ষা করে দেখা হয় কোনো ছবি বা ভিডিও ধারণ করা হয়েছে কিনা এবং ভবিষ্যতে সেখানে আর না যাওয়ার জন্য হুমকি দেয়া হয়। স্থানীয়দের ভাষায়, এসব বস্তিতে মাদক কারবারিরা ‘ওয়াচার’ নামে লোক রাখে নজরদারির জন্য।
স্থানীয় ও পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর হাজী মাজার বস্তির মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন টঙ্গী পূর্ব থানা বিএনপির সভাপতি সুমন সরকার। টঙ্গী পশ্চিম থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি রাশেদুল ইসলাম জানান, সিদ্দিকুর রহমান ওরফে ডুবলি হাজী মাজার বস্তি নিয়ন্ত্রণ করে, যিনি সুমন সরকারের লোক। তবে সুমন সরকার দাবি করেন, তার বা সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে মাদক কারবারের কোনো সম্পর্ক নেই।
হাজী মাজার বস্তির পর আরেক বড় আখড়া হলো এরশাদনগর বস্তি। এখানে মাদক ব্যবসা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ হয় না। স্থানীয়দের মতে, প্রতিবাদ করলে প্রাণনাশের ভয় আছে। তাই তারা শুধুই দেখে, কিছু বলতে পারে না।
গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি শওকত হোসেন সরকার বলেন, পুলিশ সিরিয়াস হলেই অপরাধ নির্মূল সম্ভব, নইলে নয়। তিনি আরও জানান, গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে বেশ কয়েকবার মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পুলিশ প্রশাসনকে আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্যদিকে পুলিশের দাবি, তারা নিয়মিত অভিযান চালায় এবং মাদক কারবারিদের গ্রেপ্তার করে। তবে তাদের বিরুদ্ধেও মাসোহারা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকায় মাদকের বিস্তার ঘটেছে। ওসিরা তদন্ত বা তদারকি করেন না, বরং মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন।
জিএমপি কমিশনার বলেন, কোনো ওসি টাকা নিয়ে থাকলে, কোন ওসি কত নেন তা সদর দপ্তরে রিপোর্ট করতে হবে। অথবা আমাকে রিপোর্ট দিলেও হবে। দোষ প্রমাণিত হলে ওই ওসিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আরও জানান, এর আগে উৎকোচ নেয়ার অভিযোগে চার কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাদক কারবারি আরফিনা বেগম ওরফে আরফিন বিভিন্ন বস্তি থেকে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা তোলেন। সেই টাকা সংগ্রহ করেন গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) পরিদর্শক মো. গোলাম মোস্তফা, যাকে প্রতিবেদনে কমিশনারের ‘মূল ক্যাশিয়ার’ বলা হয়েছে। তবে গোলাম মোস্তফা দাবি করেন, তিনি মাত্র পাঁচ মাস জিএমপিতে ছিলেন এবং এ ধরনের বিষয়ে তার কোনো জ্ঞান নেই।
আরও জানা যায়, আরফিনার বিরুদ্ধে টঙ্গী পূর্ব থানায় একাধিক মাদক মামলা রয়েছে। তিনি টঙ্গীর ব্যাংকের মাঠ বস্তির মাদকের নিয়ন্ত্রণ করেন। ওসি মুহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম জানান, আরফিনাকে বহুবার গ্রেপ্তার করা হলেও কিছুদিনের মধ্যেই তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে যান। তার বিরুদ্ধে কোনো কোনো মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে এবং কিছু মামলার বিচার শুরু হয়েছে। ফলে তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে মাসোহারা নেয়ার অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। একইভাবে টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি ইস্কান্দার হাবিবুর রহমানও অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন।
গাজীপুর মহানগর জামায়াতের আমির মুহা. জামাল উদ্দীন জানান, শিল্পনগরী গাজীপুরের বস্তিগুলো মাদক ও সন্ত্রাসের আখড়া। এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য এবং রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী নেতারাও জড়িত।
জিএমপি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী, গাজীপুরে ২২টি মাদকের আখড়া রয়েছে। সেগুলো হলো- কড়ইতলা বস্তি, কলাবাগান বস্তি, জিন্নাত মহল্লা বস্তি, নিশাত মহল্লা বস্তি, লাল মসজিদের পেছনের বস্তি, নামার মাজার বস্তি, ব্যাংগলের মাঠ বস্তি, মিল ব্যারাক বস্তি, ব্যাংকের মাঠ বস্তি, টঙ্গী স্টেশন বস্তি, আমতলী কেরানীটেক বস্তি, এরশাদনগর বস্তি, গাছা বস্তি, লক্ষ্মীপুরা, শিববাড়ি রেলগেট বস্তি, বরান, কোনাবাড়ি, টঙ্গী বোর্ডবাজার, ভোগড়া, সালনা, পুবাইল এবং কাশিমপুর কারাগারের পাশের বস্তি।
পুলিশের পাশাপাশি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তবে জিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) তাহেরুল হক চৌহান বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশ জোরালো অভিযান চালাতে পারছে না। কারণ আগে মাদক কারবারিরা পুলিশকে ভয় পেলেও এখন আর পাত্তা দেয় না। তবু প্রতিদিনই মাদক উদ্ধার ও গ্রেপ্তার চলছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত গত সাত মাসে জিএমপির আট থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ৪৬৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৭০৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ২৪২ ইয়াবা বড়ি, ২ হাজার ৪১ বোতল ফেনসিডিল, ৭৯৯ গ্রাম হেরোইন, ৫৮৮ কেজি গাঁজা, ১০১ লিটার বিয়ার ও ৮০৬ লিটার বিদেশি মদ।
গত বছরের জুন থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত এক বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গাজীপুর মেট্রো অঞ্চল ৩৮৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় উদ্ধার করা হয় ১ লাখ ২৩ হাজার ৬৩৪ ইয়াবা, এক কেজির বেশি হেরোইন, ২৫১ বোতল ফেনসিডিল, ২০২টি ট্যাপেন্ডাডল ট্যাবলেট, ২৬৭ কেজি গাঁজা, ৩৩৫ লিটার চোলাই মদ ও ৪৬ ক্যান বিয়ার।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) গাজীপুরের সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির বলেন, বর্তমানে গাজীপুরে মাদকের কেনাবেচা যেন সবজির মতো সহজ হয়ে গেছে। তার মতে, পুলিশ সদর দপ্তর ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমন্বিত অভিযানই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়।