
চিকুনগুনিয়া
ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার বাসাবোর গৃহবধূ জিনাত পারভিন হঠাৎ করে জ্বর ও অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথায় আক্রান্ত হন। চিকিৎসকের পরামর্শে ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে ফল নেগেটিভ পাওয়ার পর তিনি চিকুনগুনিয়ার সন্দেহে অন্তত দশটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরেছেন, কিন্তু কোথাও রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা করাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন, অথচ নিশ্চিত ছিলেন না—আসলে তিনি কী রোগে আক্রান্ত।
জিনাত পারভিনের এই অভিজ্ঞতা এখন রাজধানীর বহু মানুষের বাস্তবতা। ২০১৭ সালের পর আবারও ঢাকায় চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের উল্লম্ফন দেখা দিলেও, এই রোগকে এখনো সরকারি হাসপাতালগুলো ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’ বলে অবহেলা করে, পরীক্ষার কিট সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার এমন উদাসীনতায়, ভাইরাসটির ভয়াবহ রূপ সমাজের চোখের সামনে হলেও, প্রশাসনিক অন্ধত্ব এখনো কাটেনি।
? সংক্রমণের হার ভয়ংকর রকমের বেশি
স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বি জানিয়েছে, চলতি বছরের জুন মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে জ্বর ও উপসর্গ নিয়ে আসা ১৭১ জন রোগীর মধ্যে ১৪০ জনের শরীরে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার প্রায় ৮২ শতাংশ। এ হার শুধু উদ্বেগজনক নয়, একটি স্পষ্ট বিপদের বার্তাবহন করছে।
এ সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৯৪ জন উপসর্গধারী রোগীর নমুনার মধ্যে ৩৫ শতাংশ (১৩৮ জন) পজিটিভ। এর মধ্যে প্রায় ৯৯ শতাংশই ঢাকার বাসিন্দা। ৬৫ শতাংশ রোগী পুরুষ, এবং ৮৩ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের বেশি। এই রোগীদের মধ্যে ৯৬ শতাংশ জয়েন্ট পেইনে ভুগেছেন এবং ৮১ শতাংশের উপসর্গ ছিল ২৮ দিন পরও বর্তমান— যা দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়।
? পরীক্ষা নেই—সঠিক চিকিৎসাও নেই
২০১৭ সালে ঢাকায় প্রথম বড় আকারে চিকুনগুনিয়া দেখা দেয়। এরপর প্রায় এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় বলে গবেষকদের ধারণা। কিন্তু, ২০১৮ সাল থেকে সরকার একে ‘কম গুরুত্বের রোগ’ ঘোষণা করে হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষার কিট সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এখন কিছু নির্দিষ্ট রেফারেন্স ল্যাবরেটরি ছাড়া কোথাও সহজে পরীক্ষা করানো সম্ভব নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন পরিচালক দাবি করেছেন, “সবার রক্ত পরীক্ষা করা দরকার হয় না, ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিসই যথেষ্ট।” কিন্তু বাস্তবতা হলো—যখন ডেঙ্গু, জিকা বা করোনার মতো উপসর্গ মিলে যায়, তখন শুধু উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দিতে গেলে ভুল চিকিৎসা হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এতে রোগী আরও বেশি বিপদের মুখে পড়ে।
? চিকুনগুনিয়া: শুধু স্বাস্থ্য নয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও
গবেষণায় বলা হয়েছে, একজন চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি গড়ে হারাচ্ছেন ১০.৫ কর্মদিবস। এই অনুপস্থিতির কারণে গড়ে ৭৩.৩ মার্কিন ডলার (প্রায় ৮ হাজার টাকা) ক্ষতি হচ্ছে প্রতিজনের, যা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য বড় ধাক্কা। একজন রোগীর গিঁটে দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা, দুর্বলতা, কর্মক্ষমতা হ্রাস এমনকি হাঁটার অক্ষমতা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
? ভাইরাসের বাহক দমনেই ব্যর্থতা বেশি
চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু—দু’টিরই বাহক এডিস মশা। কিন্তু সিটি করপোরেশনগুলো কীটনাশক ছিটালেও তার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ডা. গোলাম ছারোয়ার বলেন, “বন্দুকে গুলি না থাকলে শত্রু মারা যায় না। ইনসেকটিসাইডে সক্রিয় উপাদান ঠিক আছে কি না—এমন কোনো পরীক্ষাই হয় না।”
এডিস মশার দুই প্রজাতির একটি ছায়ায় থাকে, আরেকটি খোলা জায়গায়। কিন্তু প্রজাতি অনুযায়ী আলাদা প্রতিরোধ কৌশল নেই। ভুল কৌশলে পুরো প্রক্রিয়া অর্থহীন হয়ে পড়ছে।
? জনসচেতনতা আর নগর পরিকল্পনায় বড় ঘাটতি
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র চিকিৎসা দিয়ে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। দরকার পরিচ্ছন্নতা, পানি নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা, কীটনাশকের বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ এবং সর্বোপরি জনসচেতনতা। এখনো অনেকে চিকুনগুনিয়াকে “সাধারণ জ্বর” ভাবেন, যা এই রোগের প্রকৃত ভয়াবহতাকে আড়াল করে।
? এই মুহূর্তে কী করতে হবে?
-
সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষার কিট সরবরাহ চালু করতে হবে।
-
সিটি করপোরেশনের কীটনাশক কার্যক্রমে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন প্রয়োজন।
-
চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভিন্ন বাহক অনুযায়ী পৃথক কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
-
গণসচেতনতা বাড়াতে জাতীয় পর্যায়ে ক্যাম্পেইন পরিচালনা জরুরি।
-
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।
চিকুনগুনিয়াকে আর অবহেলা করার সুযোগ নেই। এটি আর কেবল “গ্রীষ্মকালীন ভাইরাস” নয়—বরং বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্য এক নতুন নীরব সংকট। পরীক্ষা বন্ধ, প্রস্তুতির ঘাটতি, রোগ শনাক্তকরণে দেরি, বাহক দমনে অকার্যকর ব্যবস্থা—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি একটি ‘স্বাস্থ্য বিপর্যয়’-এর দিকে এগোচ্ছে।
এই ভাইরাসের মৃত্যুহার কম হতে পারে, কিন্তু জীবনের গতি থামিয়ে দিতে তার বেশি কিছু লাগে না। এখনই সঠিক পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে এর চেয়েও বড় মূল্য দিতে হতে পারে।