
নেপাল
কাঠমান্ডুর রাজপথে আবারও দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে বিক্ষোভের আগুন। সোমবার ও মঙ্গলবারের সহিংস আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটেছে। এ যেন নেপালের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি—অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি, দারিদ্র্য আর শাসনব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা।
দুর্নীতি ও দারিদ্র্যের শেকল
অপরূপ সৌন্দর্যের দেশ নেপাল, যাকে ‘হিমালয় কন্যা’ বলা হয়, বিশ্বদরবারে চরম দারিদ্র্যপীড়িত দেশ হিসেবেই পরিচিত। বিশ্বব্যাংক চলতি বছর জানিয়েছে, রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে ‘চরম দারিদ্র্য প্রায় বিলুপ্ত’। কিন্তু এ সুসংবাদও ভেতরের সংকট আড়াল করতে পারছে না। বেকারত্ব ও বৈষম্য এতটাই তীব্র যে তা সমাজে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলছে।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২–২৩ সালে ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেছে। অথচ রাজনৈতিক নেতৃত্ব একের পর এক ব্যর্থ হয়েছে। গত ১৭ বছরে সরকার বদলেছে ১৩ বার, কোনো সরকারই জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।
রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্র—সংগ্রামের ইতিহাস
নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাস মূলত টানাপোড়েনের ইতিহাস।
-
১৯৫০-এর দশকে গণতান্ত্রিক সংস্কারের সূচনা হয়। রাজা মহেন্দ্র সাংবিধানিক রাজতন্ত্র চালু করেন।
-
১৯৯০ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও আশাভঙ্গ হয় দ্রুত।
-
১৯৯৪ সালে মাওবাদীরা সশস্ত্র ‘জনযুদ্ধ’ শুরু করে রাজতন্ত্র বিলুপ্তির দাবিতে। প্রায় এক দশকের সংঘাতে প্রাণ হারায় হাজারো মানুষ।
-
২০০১ সালে রাজপরিবার হত্যাকাণ্ড দেশকে নাড়া দেয়। রাজা জ্ঞানেন্দ্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেও মাওবাদী ও রাজনৈতিক দলগুলোর চাপের মুখে ২০০৬ সালে তাকে সরে দাঁড়াতে হয়।
-
২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে নেপাল হয় ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, আর হিন্দুরাষ্ট্র থেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়।
কিন্তু প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের পরও সাধারণ মানুষের জীবনে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি।
আজকের সংকট: ব্যর্থ গণতন্ত্র, অস্থির রাজনীতি
২০০৮ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত নেপালে ক্ষমতায় এসেছে ১৩টি সরকার। দুর্নীতি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও ব্যর্থ নীতি সাধারণ মানুষকে হতাশ করেছে। রাজপথে নামা বিক্ষোভকারীরা এবার শুধু সরকারের পতন নয়, সমগ্র শাসনব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন।
অনেকেই আবারও রাজতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের আশা করছেন। বিশেষত সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্রের সমর্থকেরা মনে করছেন, হিন্দুরাষ্ট্রে ফেরা নেপালকে স্থিতিশীলতা দিতে পারে।
সেনাশাসনের শঙ্কা
বর্তমানে সেনারা দায়িত্ব নিয়েছে। জারি হয়েছে কারফিউ। যদি সেনাশাসনের বিরোধিতা বাড়ে, তাহলে দেশ আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
কোন পথে নেপাল?
প্রশ্ন এখন একটাই—কোন পথে হাঁটবে নেপাল?
-
গণতন্ত্র কি আবারও আস্থা ফিরে পাবে?
-
সমাজতান্ত্রিক স্বপ্ন কি বাস্তবে রূপ নেবে?
-
নাকি আবার রাজতন্ত্র ফিরে আসবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নামে?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নেপালিদের জন্য মূল সংকট হলো দুর্নীতি, বেকারত্ব ও বৈষম্য। এগুলো সমাধান না হলে যে শাসনব্যবস্থাই আসুক না কেন, হিমালয়ের কন্যার বুকের ক্ষোভ শান্ত হবে না।