ঢাকা,  শনিবার
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Advertisement
Advertisement

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: বেড়েছে খরচ, মেলেনি অনুমোদনের নথি

প্রকাশিত: ১২:৪০, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: বেড়েছে খরচ, মেলেনি অনুমোদনের নথি

রূপপুর

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের কোনো অনুমোদনপত্র খুঁজে পায়নি মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়। সিএজির সাম্প্রতিক এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের ব্যয় ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো চুক্তি এবং আর্থিক খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার প্রমাণ মিলেছে।

উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হলেও নেই নথি

প্রাথমিক চুক্তি অনুযায়ী, ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় প্রতিটি এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট স্থাপন করে মোট দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা ছিল। তবে ২০১৫ সালে চূড়ান্ত চুক্তিতে প্রতিটি ইউনিটের ক্ষমতা বাড়িয়ে ১,২০০ মেগাওয়াট করা হয়—মোট ২,৪০০ মেগাওয়াট। কিন্তু সিএজির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই ক্ষমতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের কোনো নথি নিরীক্ষার সময় পাওয়া যায়নি।

ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে প্রকল্পের ব্যয় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা বা ১৩.১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

সমঝোতা দল গঠন হলেও কার্যকর হয়নি

২০১২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে প্রকল্প ব্যয় চূড়ান্ত করতে একটি সমঝোতা দল গঠন করা হয়। এতে অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, বিদ্যুৎ বিভাগ ও পরমাণু শক্তি কমিশনের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন। তাদের আলোচনার মাধ্যমে ব্যয় নির্ধারণ করার কথা থাকলেও সেই কার্যক্রমের কোনো কাগজপত্র মেলেনি।

অবশেষে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর সমঝোতা ছাড়াই রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের সঙ্গে ভিভিইআর-১২০০ প্রযুক্তির দুটি ইউনিট নির্মাণে ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়। এর আগে ২০১৩-১৫ সালে প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য আরও চারটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মূল্য ছিল ০.৫৪৫৯ বিলিয়ন ডলার।

হোটেল ও আবাসন খাতে অনিয়ম

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে যন্ত্রপাতি পরীক্ষার জন্য কোয়ালিটি ইন্সপেকশন ইউনিট ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একই সময়ে ওই টিমকে হোটেলে থাকার ভুয়া দেখিয়ে শুধু ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দুই কোটি ৭৯ লাখ টাকার বেশি খরচ দেখানো হয়েছে।

এ ছাড়া প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক ও বর্তমানে এনপিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাছান রাশিয়ায় আবাসন ভাড়ার নামে নগদ ৭৭ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। অথচ প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির নির্দেশনা ছিল—ভাড়া ও সার্ভিস চার্জ বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে।

আন্তর্জাতিক তুলনায় ব্যয় বেশি

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক জ্বালানি সংস্থা (IAEA)–এর তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ায় একই প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি খরচ দাঁড়ায় ৪,০৭৫ ডলার। রূপপুর প্রকল্পে তা ৫,৮৯০ ডলার।

অন্য দেশগুলোর তুলনায়ও রূপপুরের খরচ অনেক বেশি:

  • ফিনল্যান্ড: কিলোওয়াটপ্রতি ৫,০০০ ডলার

  • তুরস্ক (আক্কুইউ প্রকল্প): কিলোওয়াটপ্রতি ৩,২০০ ডলার

বিশেষজ্ঞদের মতামত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি দেশের মর্যাদার প্রতীক হলেও প্রকল্পটির বাস্তবায়নে অস্বচ্ছতা রয়েছে, যা তদন্ত সাপেক্ষ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মন্তব্য করেন, এত বড় প্রকল্প প্রতিযোগিতা ছাড়া রাশিয়ার হাতে দেওয়াই মূল সমস্যার জায়গা। রাশিয়ার দুর্নীতিপরায়ণ ভাবমূর্তি এবং নির্মাণকারী রোসাটমের বিরুদ্ধে নানা দেশের অভিযোগ থাকায় অনিয়ম অস্বাভাবিক নয়।

রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দায়

প্রকল্পের সময়কার বিভিন্ন চুক্তি ও অনুমোদনে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তৎকালীন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। তবে এ বিষয়ে তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। সাবেক প্রকল্প পরিচালক শওকত আকবরও কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয় ও টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে প্রকল্প–সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে।

বর্তমান অবস্থা

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রোসাটম প্রকল্পটি নির্মাণ করছে। মোট ব্যয়ের ৯০ শতাংশ ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। এ পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এ বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা এক বছর পিছিয়েছে।

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531