
কাতার
কাতারের রাজধানী দোহায় সরাসরি হামলার দায় স্বীকার করেছে ইসরায়েল। মঙ্গলবারের এ হামলায় কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় হামাস নেতাকে লক্ষ্য করা হয় বলে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। ইসরায়েলি বিবৃতিতে বলা হয়—“ইসরায়েল এটি শুরু করেছে, ইসরায়েল এটি পরিচালনা করেছে এবং ইসরায়েল পূর্ণ দায় নিচ্ছে।”
এভাবে প্রকাশ্যে দায় স্বীকারের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল আবারও মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়ানোর এক ধাপ এগিয়ে গেল।
দোহায় হামলার তাৎপর্য
কাতার ফিলিস্তিন–ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি আলোচনার অন্যতম প্রধান মধ্যস্থতাকারী। দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। তবুও সেই রাজধানীতে হামলা চালানো মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নতুন মাত্রা তৈরি করেছে।
দোহাভিত্তিক লেখক ও সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল-ইমাদি বলেন, “কাতার গাজায় পরিস্থিতি শান্ত করতে এবং উভয় পক্ষকে আলোচনায় আনতে সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করছে। কিন্তু ইসরায়েল এসব প্রচেষ্টাকে একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছে না।”
বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া
-
মায়েরাভ জোনজেইন (ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ):
“ইসরায়েল যখন ইচ্ছা মধ্যপ্রাচ্যের জনবহুল এলাকা ও রাজধানীতে হামলা চালায়। এখনো করছে, ভবিষ্যতেও করবে—যদি না কেউ গুরুত্বের সঙ্গে ঠেকানোর চেষ্টা করে।” -
হামজা আত্তার (ফিলিস্তিনি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক):
“এ হামলা মোসাদের প্রচলিত কাজের ধারা থেকে আলাদা। সাধারণত তারা গাড়িবোমা, বিষ প্রয়োগ বা স্নাইপার হামলা চালায়। কাতারিরা কখনো ভাবেনি ইসরায়েল দোহায় বোমা ফেলবে।” -
চিনজিয়া বিয়াঙ্কো (ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস):
“সরাসরি দোহায় হামলা—এমন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ কেউ কল্পনাও করেনি। এটি সবাইকে অবাক করেছে।” -
ড্যানিয়েল লেভি (যুক্তরাষ্ট্র/মধ্যপ্রাচ্য প্রকল্পের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ইসরায়েলি আলোচক):
“ইসরায়েল আলোচনার প্রতি, আন্তর্জাতিক আইন ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবজ্ঞাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। প্রতিটি রাষ্ট্রের উচিত এই দায়মুক্তি ঠেকানো।”
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া
হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্র হামলার বিষয়ে অবগত ছিল, তবে এটি ইসরায়েলের একতরফা সিদ্ধান্ত। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন জানায়, হামলা ইসরায়েলি বা মার্কিন লক্ষ্য পূরণ করেনি, তবে হামাসকে আঘাত করা “যথাযথ লক্ষ্য”।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন ছাড়া ইসরায়েল এমন হামলা চালাতে সাহস করবে না। যদি সত্যিই অনুমোদন না দিয়ে থাকে, তবে তাদের উচিত নিন্দা জানানো।”
যুদ্ধবিরতি আলোচনার অচলাবস্থা
গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুক্ত হলেও ইসরায়েলের অবস্থান অনমনীয়।
-
আগের প্রস্তাবে কিছু জিম্মি মুক্তি ও সাময়িক যুদ্ধবিরতির কথা ছিল। প্রথমে সমর্থন দিলেও পরে ইসরায়েল প্রস্তাব বাতিল করে।
-
বর্তমান আলোচনায় হামাসের সব জিম্মি মুক্তির দাবি তুলেছে ইসরায়েল, বিনিময়ে শুধু সাময়িক যুদ্ধবিরতির আশ্বাস দিচ্ছে।
-
এদিকে গাজায় সামরিক অভিযান জোরদার করছে ইসরায়েল, হামাস ধ্বংস করাই তাদের ঘোষিত লক্ষ্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল প্রকৃত অর্থে কোনো যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহী নয়।
আঞ্চলিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
কাতার দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে। ইরান–যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কিন্তু এবার সরাসরি ইসরায়েলি হামলার শিকার হয়ে কাতার আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরও জোরালো অবস্থান নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
-
ক্রিস্টিয়ান কোটস উলরিখসেন (রাইস ইউনিভার্সিটি):
“কাতার ও উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের কর্মকর্তারা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে জানতে চাইবেন—তারা কি এ হামলায় সম্মতি দিয়েছিল? যদি দিয়ে থাকে, তবে এটি যুক্তরাষ্ট্র–উপসাগরীয় নিরাপত্তা অংশীদারত্বের জন্য ভয়াবহ আঘাত।” -
চিনজিয়া বিয়াঙ্কো:
“একসময় মার্কিন ঘাঁটি ও সেনা মোতায়েন কার্যকর প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করত। কিন্তু এখন সেটি ভেঙে পড়েছে। ফলে উপসাগরীয় দেশগুলো মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ওপর আস্থা হারাতে পারে।”
দোহায় ইসরায়েলের প্রকাশ্য হামলা শুধু কাতার নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। একদিকে যুদ্ধবিরতি আলোচনার মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার আক্রান্ত হলো, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নীরব প্রতিক্রিয়া আঞ্চলিক মিত্রদের জন্য নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে।