
বিকেলের শেষ আলোয় কিশোরগঞ্জের গাঙ্গাটিয়া জমিদারবাড়ি যেন থেমে থাকা সময়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, পুকুরপাড়ে ভেসে বেড়ানো পাখির ডাক, আর মাঝখানে এক বৃদ্ধ মানুষ—মানবেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী। আশপাশের মানুষ তাঁকে স্নেহভরে ডাকেন ‘মানব বাবু’। সরকারি নথিতে এটি গাঙ্গাটিয়া জমিদারবাড়ি হলেও, স্থানীয়দের কাছে বাড়িটির নাম হয়ে গেছে মানব বাবুর বাড়ি।
সময়ের সাক্ষ্য
আঠারো শতকে নির্মিত এই প্রাসাদ উত্তরবঙ্গের বিশাল জমিদারবাড়ির মতো নয়, তবে এর গ্রিক ধাঁচের স্তম্ভ আর দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বার এখনো আভিজাত্য আর শিল্পরুচির স্মৃতি বহন করে। দিননাথ চক্রবর্তী ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। উত্তরাধিকার সূত্রে অতুল, শ্রীধর, ভূপতি—প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে জমিদারি চালু ছিল। শেষ জমিদার ভূপতি চক্রবর্তীর ছেলে মানব বাবু আজ এই উত্তরাধিকারের একমাত্র জীবন্ত প্রতীক।
বাড়িটিতে ছিল কাচারিঘর, নহবতখানা, অতিথিশালা, মন্দির, প্রশস্ত পুকুর। এখনও দেখা যায় খোদাই করা খাট, কাঠের আসবাব আর সংস্কৃত ভাষায় খোদাই করা “স্বাগতম” লেখা ফটক।
মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন
১৯৭১ সালে গাঙ্গাটিয়া জমিদারবাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের মুখে পড়ে এটি। সেই হামলায় মানব বাবুর বাবা ভূপতি চক্রবর্তীসহ পরিবারের কয়েকজন নিহত হন। বাকিরা ভারতে পালান, কিন্তু তরুণ মানব বাবু গ্রাম ছাড়েননি।
তিনি বলেন, “আমার বাবা-পুর্বপুরুষরা এখান থেকেই জমিদারি চালিয়েছেন। জমিদারি নেই, আত্মীয়ও নেই। তবু আমি এই মাটি ছাড়ব না।”
আজও বাড়ির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে একটি সরল স্মৃতিস্তম্ভ, যেখানে নীরবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধারণ করে মানুষ মাথা নত করে।
শেষ জমিদার মানব বাবু
জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও গাঙ্গাটিয়ার মানুষ মানব বাবুকে এখনও ‘জমিদার সাহেব’ বলেন। অথচ নেই ধন-সম্পদ বা চাকর-বাকর। বয়স ৯২, ধীরে হাঁটেন, কিন্তু ভঙ্গিমায় এখনো শিকড়ের দৃঢ়তা।
যুদ্ধোত্তর সময়ে তিনি রাজনীতিতে আসেননি, তবু মানুষের অনুরোধে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়েছিলেন। ছিলেন সহজ-সরল, ন্যায়পরায়ণ জনপ্রিয় নেতা।
সংস্কৃতির আসর
গাঙ্গাটিয়ার জমিদারবাড়ি কেবল স্মৃতির ভান্ডার নয়, আজও এটি একটি জীবন্ত সংস্কৃতির কেন্দ্র। সন্ধ্যায় আঙিনায় বৈঠকি গান হয়, হারমোনিয়াম, তবলা আর বাঁশির সুর ভেসে যায় পুকুরপাড়ে। কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, এমনকি সিলেট থেকেও সংগীতশিল্পীরা আসেন। মাঝে মাঝে মানব বাবুও গান ধরেন—দুর্বল শরীরের ভেতর থেকে উঠে আসে আশ্চর্য শক্তির কণ্ঠস্বর।
তিনি হাসতে হাসতে বলেন, “এই আসরগুলোতে মনে হয় যেন পুরোনো দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে।”
বর্তমানের প্রাণচাঞ্চল্য
বাড়ির পাশে মাছের খামার থেকে বাজার ও সেনাবাহিনীতে সরবরাহ হয় টাটকা মাছ। এ উদ্যোগেই টিকে আছে পরিবারের জীবনধারা ও ঐতিহ্যের কেন্দ্র। প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটক, শিক্ষার্থী ও গবেষকরা আসেন—জীবন্ত জমিদার মানব বাবুর সঙ্গে দেখা করার জন্য।
একজন দর্শনার্থীর ভাষায়: “এখানে আসা মানে ইতিহাসের ভেতর প্রবেশ করা।”
জমিদারবাড়ির দীর্ঘ ছায়া
বাংলাদেশের অধিকাংশ জমিদারবাড়ি আজ ধ্বংসস্তূপ। তবে গাঙ্গাটিয়া এখনও টিকে আছে—এক বৃদ্ধ মানুষের দৃঢ় উপস্থিতিতে। জমিদারি প্রথার ক্ষমতা ও বৈষম্যের গল্পের পাশাপাশি এখানে মিশে আছে সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ আর মানুষের টিকে থাকার কাহিনি।
গাঙ্গাটিয়ার প্রাঙ্গণে হাঁটলেই বোঝা যায়—এ শুধু অতীত নয়, বর্তমানেরও অংশ। মানব বাবুই গাঙ্গাটিয়ার জমিদারবাড়ির আসল ইতিহাস—জীবন্ত কিংবদন্তি।