
জেন–জি আন্দোলন
লোহার ফটক ভেঙে জনতার ঢল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকে পড়া—এ দৃশ্য একসঙ্গে মনে করিয়ে দেয় নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলনের কথা। একসময় ক্ষমতার প্রতীক যে ভবনগুলো ছিল নাগালের বাইরে, সেগুলো কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও সাধারণ মানুষ দখল করে নেয়।
তরুণদের স্বপ্ন ও বাস্তবতার ফারাক
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল স্ট্যানিল্যান্ডের ভাষায়, এসব আন্দোলনের মূল শক্তি হলো তরুণদের স্বপ্ন দেখা—ভালো রাজনীতি ও অর্থনীতির কল্পনা। কিন্তু স্বপ্ন ও বাস্তব জীবনের বিশাল ফারাক তাঁদের ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ প্রজন্ম দেখিয়ে দিচ্ছে, তারা বিদ্যমান ব্যবস্থায় আস্থা না পেলে নিজেরাই বিকল্প খুঁজে নিচ্ছে।
নেপালের বিদ্রোহ
৩০ মিলিয়ন মানুষের দেশ নেপালে সাম্প্রতিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয় সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে। ক্ষোভের গভীরে ছিল বৈষম্য, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। কয়েক দিনের সহিংস বিক্ষোভে ৭০ জনের বেশি নিহত হন। এরপর তরুণেরা ডিসকর্ডে ভোট দিয়ে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন। তরুণদের উপহাস করার পরপরই প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা ওলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের অভ্যুত্থান
২০২৪ সালে বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটার বিরুদ্ধে। পুলিশি দমন–পীড়নে বহু হতাহতের পর সেটি রূপ নেয় শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে। ইন্টারনেট বন্ধ করা, ছাত্রদের ওপর দমননীতি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান।
শ্রীলঙ্কার সংগ্রাম
শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালে অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকেই আন্দোলনের সূত্রপাত। মুদ্রাস্ফীতি, লোডশেডিং ও জ্বালানি সংকটে সাধারণ মানুষের জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে। তরুণেরা শুরু করেন ‘আরাগালায়া’ আন্দোলন, প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে তৈরি হয় ‘গোতাগোগামা’। অবশেষে জুলাইয়ে রাজাপক্ষে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
মিল ও শিক্ষা
তিন দেশের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও মিলও রয়েছে—বৈষম্য, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অভিজাতদের স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে তরুণদের ক্ষোভ। প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর বয়স ২৮ বছরের নিচে হওয়ায় এ আন্দোলন দ্রুত জনসমর্থন পেয়েছে। আন্দোলনগুলো জাতিগত নয়; বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়ের প্রশ্নে দেশব্যাপী সাড়া ফেলেছে।
মানবাধিকারকর্মী মীনাক্ষী গাঙ্গুলি মনে করেন, পুরোনো প্রজন্মের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও তরুণদের হতাশার ফারাকই ক্ষোভের মূল উৎস। রুমেলা সেন বলেন, আন্দোলনগুলো গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা, জবাবদিহি ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের দাবি থেকে জন্ম নিয়েছে।
ডিজিটাল যুগের নতুন কৌশল
নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের তরুণেরা শুধু একে অপরের কাছ থেকেই নয়, ইন্দোনেশিয়া–ফিলিপাইনের মতো দেশ থেকেও কৌশল শিখেছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছাড়াই সংগঠিত হওয়া, সামাজিক মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ প্রচার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার—এসব তাদের আন্দোলনকে নতুন রূপ দিয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় তরুণ প্রজন্মের বিদ্রোহ এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। প্রশ্নটি এখন একটাই—পরবর্তী আন্দোলন কোথায় শুরু হবে?