ঢাকা,  রোববার
০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Advertisement
Advertisement

সুদানের নারীদের বেঁচে থাকার লড়াই: চাদে শরণার্থী শিবিরেও যৌন সহিংসতার শিকার

প্রকাশিত: ০৮:০৫, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সুদানের নারীদের বেঁচে থাকার লড়াই: চাদে শরণার্থী শিবিরেও যৌন সহিংসতার শিকার

সুদানের নারী

নভেম্বর ২০২৩ সালের এক বিমান হামলা বদলে দিয়েছিল ইসলামের* জীবন। সুদানের এল-জেনিনার তরুণী ইসলাম তখন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় বিমান হামলার গোলা গিয়ে পড়ে তাদের বাড়িতে।

যদিও পরিবার বেঁচে যায়, কিন্তু এরপর ইসলামকে অপহরণ করে দ্রুত সহায়তা বাহিনী (RSF) নামের সুদানি আধাসামরিক গোষ্ঠী। তারা হুমকি দেয়—পরিবারকে হত্যা করা হবে যদি ইসলাম তাদের চাহিদা না মেনে নেয়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে ইসলাম বলেন:
“আমাকে যদি তারা হত্যা করত, তবে ভালো হতো। তারা যা করেছে, তা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর।”

দুই দিন ধরে তাকে বন্দি করে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়। শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক আঘাতে তিনি এখন হাঁপানি রোগে ভুগছেন, যা আগে কখনো ছিল না।

দুই দিন পর যখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, ততক্ষণে তাদের ঘর লুট হয়ে গেছে। পরিবার ছিন্নভিন্ন।


শরণার্থী শিবিরেও নিরাপত্তাহীনতা

অবশেষে ইসলাম তার মা, বোন–ভাইদের খুঁজে পান চাদের সীমান্তবর্তী আদ্রের শরণার্থী শিবিরে। কিন্তু সেখানেও নেই নিরাপত্তা।

প্রায় ৪০ হাজার মানুষের ছোট্ট শহর আদ্রে এখন প্রায় আড়াই লাখ সুদানি শরণার্থীর আবাস। খরা–পীড়িত এই এলাকায় পানি, আশ্রয় আর খাদ্যের মারাত্মক সংকট। দাম বেড়ে গেছে নিত্যপণ্যের। চুরি–ডাকাতি বেড়েছে ভয়াবহভাবে।

ইসলাম জানান:
“বাজারে তরুণী মেয়েকে পাঠানো যায় না। ছিনতাই বা মারধরের শিকার হতে পারে।”

পরিবার চালানোর জন্য তিনি রাস্তার মোড়ে চা বিক্রি করেন। কিন্তু প্রতিদিনই হয়রানির শিকার হন। রমজানে একদিন রাত করে কাজ শেষে বোনকে নিয়ে টুকটুকে ফিরছিলেন। টুকটুক নষ্ট হয়ে গেলে চাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আটকে ফেলে।

“তোমরা সুদানি, নিজেদের দেশ নষ্ট করে এখন আমাদের দেশও নষ্ট করতে এসেছ,”—বলে অভিযুক্ত সেনারা। এরপর ইসলাম ও তার বোনকে আলাদা গাড়িতে তুলে নেয়।

ইসলামকে এক সেনা ধর্ষণ করে। পরে হাসপাতালে ফেলে যায়। রক্তে ভেজা অবস্থায় চিকিৎসা নিলেও লজ্জায় ধর্ষণের কথা চিকিৎসককে বলতে পারেননি। বিছানার পাশের আরেকজন ধর্ষণের শিকার নারী শুধু বলেছিলেন:
“ওরা সবসময়ই এটা করে।”


ভয়, হতাশা আর ভাঙা জীবন

জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, সুদানে RSF বাহিনী পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব ও গণধর্ষণের মতো অপরাধ চালিয়ে আসছে। শুধু সুদানের ভেতরেই নয়, চাদে পালিয়েও অনেক নারী আবারও একই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

২০২৪ সালে চাদে ৪ হাজারেরও বেশি নারী ও কিশোরী লাঞ্ছিত হয়েছেন—যার মধ্যে সুদানি শরণার্থীও রয়েছেন। অথচ স্থানীয় প্রশাসন দাবি করছে, আদ্রে শিবিরে যৌন সহিংসতার কোনো সমস্যা নেই।

কিন্তু স্থানীয় নারী নেত্রী ইসা দারা সালামা জানাচ্ছেন, শুধু পুলিশ নয়—শরণার্থী ও স্থানীয় পুরুষদের কাছ থেকেও নারীরা হামলার শিকার হচ্ছেন। শিশুদের ধর্ষণের ঘটনা নতুনভাবে ভয়াবহ আকার নিচ্ছে।


রুয়া’র গল্প: এক ভাঙা কৈশোর

১৮ বছরের রুয়া* স্মরণ করেন, RSF বাহিনী তাদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ভাই, চাচা ও প্রতিবেশীরা নিহত হন। তিনি ও তার স্কুলের বন্ধুরা অপহৃত হন এবং গণধর্ষণের শিকার হন।

চাদে পালিয়ে এসে তিনি আবার এক চাদিয়ান পুলিশ সদস্যের হাতে ধর্ষিত হন। সেই ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয় তার শিশু কন্যা আ’ওয়া।

রুয়া বলেন:
“ভেতরে ভেতরে আমি ভেঙে গেছি। অনেক সময় খাওয়া হয় না, ঘুম হয় না। মানুষের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছাও চলে গেছে।”


শিশুদের ওপর নির্মমতা

সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে ৩৫ বছর বয়সী লাচাম* ও তার তিন বছরের মেয়ে হেলওয়া’র* জীবনে। প্রতিবেশী এক পুরুষ তাদের ছোট্ট মেয়ে হেলওয়াকে ধর্ষণ করে। রক্তে ভেজা অবস্থায় শিশুটিকে হাসপাতালে নিতে হয়।

এখন হেলওয়া আতঙ্কে ভোগে, সবসময় চিৎকার করে বলে:
“সে আবার আমাকে রক্তাক্ত করবে!”

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত অল্প বয়সী শিশুদের মানসিক আঘাত সারাজীবনের জন্য থেকে যেতে পারে।


তহবিল সংকটে মানবিক সহায়তা

জাতিসংঘ জানিয়েছে, পূর্ব চাদে শরণার্থীদের সহায়তার জন্য ২০২৫ সালের প্রয়োজনীয় অর্থের মাত্র ২০ শতাংশ মিলেছে। অর্থাভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মানসিক সহায়তাসহ বহু প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে ধর্ষণের শিকারদের জন্য ন্যায়বিচার আরও দূরের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের কাছে অভিযোগ করলেও অপরাধীরা প্রভাবশালী গ্যাংয়ের ছত্রচ্ছায়ায় মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।


ন্যায়বিচারের দাবিতে নারীরা

ইসলাম, রুয়া, লাচাম—সবাই এখনো বেঁচে আছেন ভয়, লজ্জা আর হতাশা নিয়ে। কিন্তু তাদের দাবি শুধু একটাই—ন্যায়বিচার

লাচাম কাঁদতে কাঁদতে বলেন:
“টাকা দিয়ে কোনো সাহায্য হয় না। আমার দরকার ন্যায়বিচার।”

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531