
ফলের বাজার
ফলের দোকানে সারা বছরই পাওয়া যায় বিদেশি ফল আপেল ও মাল্টা। স্বাদে ও পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এসব ফল খাওয়ার পেছনে গত অর্থবছরে বাংলাদেশিদের ব্যয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ছুঁয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বাজারদরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই বিশাল অঙ্কের হিসাব পাওয়া গেছে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে আমদানি হয়েছে ১৬ কোটি ১৪ লাখ কেজি আপেল এবং ১৬ কোটি ৮৬ লাখ কেজি মাল্টা। সব মিলিয়ে আমদানি হয়েছে প্রায় ৩৩ কোটি কেজি বিদেশি ফল। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের হিসাব অনুযায়ী (জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৫৭ লাখ), এতে মাথাপিছু ফল ভোগ দাঁড়ায় প্রায় ১ কেজি ৮৭৮ গ্রাম। আর এর পেছনে গড়ে খরচ হয়েছে ৫৬২ টাকা। পরিবারপ্রতি বার্ষিক খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২ হাজার ৪৩০ টাকা।
খুচরা বাজারে গত বছর আপেলের গড় দাম ছিল প্রতি কেজি ৩০০–৩২০ টাকা, রয়েল গালা জাতের দাম ৩৪০–৩৮০ টাকা, আর মাল্টার দাম ছিল গড়ে ২৮০ টাকা। এই দামে হিসাব করলে, আপেল কেনার পেছনে দেশে খরচ হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা এবং মাল্টার পেছনে ৪ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৯ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা।
টাকা গেল কোথায়?
এই বিপুল অর্থের একটি বড় অংশই বিদেশে চলে গেছে। শুধু আপেল আমদানিতে ১০ কোটি ২২ লাখ ডলার (প্রায় ১,১২৭ কোটি টাকা) গিয়েছে চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, পোল্যান্ডসহ ১৫টি দেশের ৭০২ রপ্তানিকারকের কাছে। একইভাবে, মাল্টা আমদানিতে খরচ হয়েছে ১০ কোটি ডলার (প্রায় ১,১০৫ কোটি টাকা)। এসব আমদানির ফলে সরকারের রাজস্ব আদায়ও হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে—শুধু আপেল ও মাল্টা থেকেই প্রায় ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকা।
ক্রেতাদের ব্যয় থেকে বিদেশি রপ্তানিকারক পেয়েছেন ২ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, আর বাকি অর্থ বন্দর খরচ, পরিবহন, সংরক্ষণ, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের মার্জিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
কর্মসংস্থানও হয়েছে বিপুল
এই ফল আমদানিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল একটি কর্মসংস্থান কাঠামো। এনবিআর বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ফল আমদানিতে জড়িত ছিল ৪৬৯ প্রতিষ্ঠান। আমদানি থেকে শুরু করে পাইকারি, খুচরা, পরিবহন ও সংরক্ষণ পর্যন্ত কয়েক ধাপে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম জানান, শুধুমাত্র ফল আমদানি ও বিপণন খাতেই সারা দেশে অন্তত ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
কেন গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্য?
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এই খাতে কর্মসংস্থান তৈরি হলেও আমদানিনির্ভরতা উদ্বেগের বিষয়। দেশীয় ফল উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ানো না গেলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের ঝুঁকি আরও বাড়বে। পাশাপাশি ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী জনগণের মাঝে পুষ্টিসমতা বজায় রাখাও একটি চ্যালেঞ্জ।
গড় হিসেবে একজন মানুষ গত বছর ১ কেজি ৮৭৮ গ্রাম আপেল-মাল্টা খেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এই ভোগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেইসব মানুষের অংশও, যারা একটিও ফল খেতে পারেননি।
সিদ্ধান্তের সময় এখন
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমদানিনির্ভর ফল চাহিদা পূরণের পাশাপাশি স্থানীয় কৃষকদের উৎসাহিত করে আপেল-মাল্টার দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়, পুষ্টির সমতা এবং কর্মসংস্থান—সব একসঙ্গে অর্জন করা সম্ভব হবে।