
ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার দীর্ঘদিনের ছায়াযুদ্ধ এক নতুন মাত্রায় প্রবেশ করেছে। এবার সরাসরি বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়কেই লক্ষ্যবস্তু করা শুরু হয়েছে। ১৯ জুন ভোরে ইসরায়েলের বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সে ইরানের ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। এতে প্রাণহানি না হলেও ব্যাপক ক্ষতি হয় একাধিক ল্যাবরেটরিতে, ধ্বংস হয় বছরজুড়ে চলা গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণা।
বিজ্ঞানীদের উপর সরাসরি হামলা: নতুন যুদ্ধনীতি?
ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউটের আণবিক স্নায়ুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ওরেন শুলডিনার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "ল্যাবটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা আমাদের বিজ্ঞানের মুকুট রত্নে আঘাত করেছে।" ইসরায়েলের বিজ্ঞানীদের কাছে এটি ছিল একটি সরাসরি বার্তা: তাদের জীবন ও কাজ এখন আর নিরাপদ নয়।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের ইতিহাসে ইসরায়েল বহু বছর ধরে ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের টার্গেট করে আসছে। বিজ্ঞানী হত্যার পাশাপাশি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতেও চালানো হয়েছে গুপ্ত হামলা। এখন প্রথমবারের মতো পাল্টা আঘাতে ইরান ইসরায়েলের বিজ্ঞান গবেষণাকেই লক্ষ্যবস্তু করেছে বলে আশঙ্কা করছে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
গোপন যুদ্ধ থেকে প্রকাশ্য হামলা
ইসরায়েলের শীর্ষ পর্যায়ের গবেষণা ও প্রতিরক্ষা সহযোগী হিসেবে পরিচিত ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট। এলবিট সিস্টেমসহ বিভিন্ন প্রতিরক্ষা শিল্পের সাথে যৌথ গবেষণার কারণে এটি দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের নজরে ছিল। এমনকি গত বছর ইসরায়েলি গোয়েন্দারা একটি ইরানি গুপ্তচর চক্র ভেঙে দেয়, যারা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের অনুসরণ করছিল।
তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ-এর ইরান বিষয়ক বিশ্লেষক ইয়োয়েল গুজানস্কি বলেন, "ওয়েইজম্যান ইরানের নজরেই ছিল, যদিও হামলা পরিকল্পিত ছিল কি না তা নিশ্চিত নয়। তবে এটা পরিষ্কার, ইরান এখন ইসরায়েলের বিজ্ঞানীদেরও শত্রুপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে।"
ধ্বংস হওয়া ভবন, স্থবির গবেষণা
ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ক্ষেপণাস্ত্রটি দুটি ভবনে আঘাত হানে। এর একটি ছিল পূর্ণ কার্যকর জীবন বিজ্ঞান গবেষণাগার, অন্যটি নির্মাণাধীন। তবে বিস্ফোরণ ও ধ্বংসাবশেষের কারণে আশপাশের অনেক ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জৈব রসায়নের অধ্যাপক সারেল ফ্লেইশম্যান বলেন, "বেশ কয়েকটি ভবন আক্ষরিক অর্থে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই ল্যাবগুলো টিস্যু সংস্কৃতি, ক্যান্সার গবেষণা ও বিকাশগত জীববিজ্ঞানের মতো সংবেদনশীল খাত নিয়ে কাজ করত।"
একজন অধ্যাপকের এক্সে শেয়ার করা ছবিতে দেখা যায়, একটি বিধ্বস্ত ভবনের কাছে আগুন জ্বলছে, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ধাতব খণ্ড ও ধ্বংসাবশেষ। সিলিং ধসে পড়েছে, জানালার কাঁচ ভাঙা, দেয়াল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
ইতিহাস ও গুরুত্ব
১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট ইসরায়েলের প্রথম রাষ্ট্রপতি হাইম ওয়েইজম্যান-এর নামে নামাঙ্কিত। বিশ্বের অন্যতম সেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত এই ইনস্টিটিউটে যুক্ত ছিলেন রসায়নের এক নোবেল বিজয়ী এবং তিনজন টুরিং পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী। এরা ১৯৫৪ সালে ইসরায়েলের প্রথম কম্পিউটার তৈরিতেও ভূমিকা রেখেছিলেন।
প্রতীকী বার্তা, বাস্তব ক্ষতি
গুজানস্কি মন্তব্য করেন, "ইনস্টিটিউটটির ওপর হামলা ইরানের কৌশলের রূপান্তরকে বোঝায়। বার্তাটি স্পষ্ট: ইসরায়েল যদি আমাদের বিজ্ঞানীদের হত্যা করে, আমরাও তাদের বৈজ্ঞানিক ক্ষমতাকে লক্ষ্য করব।"
এই হামলা শুধু এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়, এটি ভবিষ্যতের বহু বৈজ্ঞানিক অর্জনের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। একইসাথে বৈজ্ঞানিক পরিসরকেও পরিণত করেছে যুদ্ধক্ষেত্রে—যেখানে তথ্য, গবেষণা, এবং এখন প্রাণও হয়ে উঠছে সংঘর্ষের অস্ত্র।
বিশ্ববাসী এখন তাকিয়ে, এই বৈজ্ঞানিক যুদ্ধ থামাতে কূটনীতি কতটা কার্যকর হয়। নতুবা বিজ্ঞান, মানবতা ও ভবিষ্যত—সবই অনিশ্চিত পথে হাঁটবে।