
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। গত ১৩ জুন ইসরায়েলের আচমকা বিমান হামলায় ইরানের সামরিক ও পরমাণু কেন্দ্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা পাল্টাপাল্টি আঘাতের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অংশগ্রহণ—যার আওতায় নাতাঞ্জ, ইশ্ফাহান ও ফোরদোর মতো গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়।
এ হামলাকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ঘোষণা’ হিসেবে বিবেচনা করছে তেহরান। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি পাল্টা জবাবের অধিকার রাখার কথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন।
বিশ্বজুড়ে এখন একটাই প্রশ্ন—ইরান কী করবে?
ইরানের সামনে তিন কৌশল
১. পাল্টা কিছু না করা:
এ পথ বেছে নিলে ইরান আরও বড় হামলা থেকে মুক্তি পেতে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, প্রতিশোধ নেওয়া হলে আরও ভয়াবহ হামলা হবে। কিন্তু কিছু না করলে ইরানের নেতৃত্ব দুর্বল বলে বিবেচিত হবে, এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব মুখ থুবড়ে পড়বে।
২. তাৎক্ষণিক ও কঠিন জবাব:
ইরানের হাতে এখনো বিপুল পরিমাণ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন আছে। তারা সিরিয়া, ইরাক ও লেবাননের ঘাঁটি থেকে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাতে পারে, বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থানরত মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর ওপর।
৩. সময় নেওয়া এবং পরে পাল্টা আঘাত:
এটাই সবচেয়ে সম্ভাব্য কৌশল বলে মনে করছেন অনেকে। ইরান হয়তো কূটনৈতিক সময়কে কাজে লাগিয়ে প্রতিরোধ গড়তে চাইবে। পরে, যখন যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল অপ্রস্তুত থাকবে, তখন হামলা করতে পারে।
'প্রতিরোধ অক্ষ' দুর্বল?
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি ও অন্যান্য ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলো এখন অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইরানের সামরিক সক্ষমতাও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ 'দীর্ঘ সংঘাতের সূচনা'?
যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী পদক্ষেপকে ‘সুদীর্ঘ যুদ্ধের সূচনা’ হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাবেক মার্কিন উপদেষ্টা ডেভিড ফিলিপস বলেন, “এটি এক বিপজ্জনক ভুল যা পারসিয়ান জাতীয়তাবোধকে তুচ্ছ করেছে।” এদিকে কুইন্সি ইনস্টিটিউটের অ্যাডাম উইনস্টেইন আশঙ্কা করছেন, এই সংঘাত সহজে শেষ হবে না, বরং দীর্ঘ মেয়াদে বিস্তৃত হবে।
পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস, নাকি বিলম্বিত?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করছেন, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু তেহরানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ক্ষয়ক্ষতি সামান্য, এবং ইউরেনিয়াম আগেই অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, কর্মসূচিটি সাময়িক থমকে গেলেও পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। বরং এটা আরও গোপনভাবে চালানো হতে পারে।
ভবিষ্যৎ কী?
ত্রিতা পারসি এবং আলি হার্বের মতো বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই হামলার প্রতিক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদী হবে। ইরান হয়তো এখন এনপিটি (পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি) থেকে বেরিয়ে যাবে। একইসঙ্গে নিরাপত্তার জন্য অন্যান্য দেশগুলোও পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনে উৎসাহিত হবে।
ত্রিতা পারসি বলেন, “পরমাণু অস্ত্রধারী দুটি দেশ একটি অস্ত্রহীন রাষ্ট্রে হামলা চালিয়েছে। ইরান এই হামলার জবাব দিতেই বাধ্য, না হলে তাদের সরকার হুমকির মুখে পড়বে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে আমি নিশ্চিতভাবে মনে করি, আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে ইরান একটি পরমাণু অস্ত্রধারী রাষ্ট্রে পরিণত হবে।”
এই পরিস্থিতি কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে বাধ্য করবে। বিশ্ব কি তাহলে আরেকটি বড় পরমাণু প্রতিযোগিতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? সময়ই বলবে।