
ঢাকা
২০২৩ সালের শেষের দিকে উদ্বোধনের পর থেকেই '৩০০ ফিট' নামে পরিচিত পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকার অন্যতম জনপ্রিয় আড্ডার স্থানে পরিণত হয়েছিল। ঢাকার ব্যস্ত নগরজীবনে যেখানে খোলা জায়গার অভাব, সেখানে ৩০০ ফিটের বিশালাকৃতির গোলাকার জাংশন হয়ে উঠেছিল বাইক রেস, টিকটক শুটিং, কিংবা রাতের আড্ডার জন্য আদর্শ স্থান। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে সেই চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে, মূলত নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে।
২০২৩ সালের চিত্র: প্রাণবন্ত আড্ডা ও উন্মাদনা
গত বছরের মার্চ মাসে সন্ধ্যার পর ৩০০ ফিট এক অনন্য পরিবেশ ধারণ করত। বাতিগুলোর আলোয় প্রশস্ত রাস্তাটি আলোকিত হয়ে উঠত এবং মানুষের জটলা জমত চারপাশে। কেউ সূর্যাস্ত উপভোগ করত, কেউবা ব্যস্ত থাকত ছবি তোলায়। টিকটকারদের ভাইরাল নাচ, তরুণদের গাড়ি প্রদর্শনী, এবং উৎসুক জনতার ভিড়ে বোঝা কঠিন হয়ে পড়ত এটি সত্যিই একটি মহাসড়ক, নাকি কোনো উন্মুক্ত পার্ক।
২০২৪ সালের চিত্র: নিরাপত্তা শঙ্কায় শূন্যতা
এ বছরের ১৫ মার্চ আবারও ৩০০ ফিট পরিদর্শন করলে পুরো দৃশ্যপট বদলে যেতে দেখা যায়। বিকেল ৪টায় কুরিল বিশ্বরোড থেকে নীলা মার্কেট পর্যন্ত যাত্রার পর দেখা যায়, চারপাশে মানুষের আনাগোনা খুবই কম। শুধুমাত্র গাড়ির অবিরাম চলাচল লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। সন্ধ্যা নামার পরও লোকসমাগম না বাড়ার বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়।
ব্যবসার মন্দাভাব ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
নীলা মার্কেটের অধিকাংশ দোকান রাতের আগেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। স্থানীয় দোকানদারদের মতে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং চুরি, খুনের মতো অপরাধ বৃদ্ধির কারণে যৌথ বাহিনী কঠোর অবস্থান নিয়েছে। রাত ১২টার পর সেনাবাহিনী টহল দেয় এবং দোকানপাট বন্ধ করে দেয়। ফলে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন।
এক দোকানদার বলেন, 'আগে দোকানগুলো সারারাত খোলা থাকত, কিন্তু এখন নিরাপত্তার কারণে রাত ১২টায় বন্ধ হয়ে যায়। এতে আমাদের ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।'
অপরাধ বৃদ্ধি ও দুর্ঘটনার ভয়াবহতা
এই এলাকায় চুরি, ডাকাতি এবং খুনের মতো অপরাধ বেড়েছে। এক মাস আগে এক ব্যবসায়ীর লাশ কাছের লেকে পাওয়া যায়, যা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। রাত্রিকালীন সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং অবৈধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও র্যাবের উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে।
এছাড়া, সড়কটি যানবাহন ও পথচারীদের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে বুয়েটের এক শিক্ষার্থী প্রাইভেট গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারান। ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসেই ১২টি দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে। গত পাঁচ বছরে এই সড়কে ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, অবৈধ পার্কিং, অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত গতি এবং হেলমেটবিহীন মোটরসাইকেল চালনা।
প্রশাসনের পদক্ষেপ
নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে যৌথ বাহিনী নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে অবৈধ পার্কিং, ফিটনেসবিহীন যানবাহন এবং অতিরিক্ত গতির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ১১৯টি মামলা করা হয় এবং ২ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
এক বছর আগের ৩০০ ফিট যেখানে বিনোদনপ্রেমীদের মিলনস্থল ছিল, সেখানে এখন নিরাপত্তার কড়াকড়ি এবং অপরাধের ভয়াবহতায় আগের সেই উন্মাদনা আর নেই। প্রশাসনের কঠোর নজরদারির কারণে সড়কটি কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও, রাতের বেলা এখন আর এটি আগের মতো নিরাপদ বা আকর্ষণীয় নয়।