ঢাকা,  শনিবার
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Advertisement
Advertisement

আরব–ইসলামী আকাশপথ অবরোধ: ইসরায়েলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত যেসব ক্ষতি

প্রকাশিত: ১৪:৪৪, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আরব–ইসলামী আকাশপথ অবরোধ: ইসরায়েলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত যেসব ক্ষতি

ইসরায়েলের আকাশ

 পটভূমি ও ঘটনাপ্রবাহ

২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের শীর্ষ নেতাদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় ছয়জন নিহত হন, তাঁদের মধ্যে একজন কাতারের নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলেন। তবে হামাসের কোনো শীর্ষ নেতা নিহত হয়নি। এ ঘটনাকে কাতার ও আরব বিশ্ব সরাসরি নিজেদের নিরাপত্তার ওপর আঘাত হিসেবে দেখছে।

এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর কাতারে জরুরি বৈঠকে বসে আরব লীগ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)-এর প্রায় ৬০টি দেশের নেতা ও কর্মকর্তা। বৈঠকে আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কী ধরনের যৌথ পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এই প্রেক্ষাপটে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মালিকানাধীন আল হাবতুর রিসার্চ সেন্টার একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করে, যেখানে আরব ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সম্ভাব্য সমন্বিত আকাশপথ অবরোধ নিয়ে আলোচনা করা হয়।


 অর্থনৈতিক প্রভাব

 জিডিপি সংকোচন

  • গবেষণাকেন্দ্রটির মতে, আকাশপথ অবরোধের ফলে ইসরায়েলের মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) ৪.৮% থেকে ৫.৭% পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।

  • অর্থাৎ সরাসরি মন্দার মুখে পড়বে দেশটি।

  • বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাবে, চুক্তি বাতিল হবে এবং ইসরায়েলভিত্তিক গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম অন্য দেশে সরে যেতে পারে।

 বিমান পরিবহন খাত

  • বিকল্প রুট ব্যবহার করতে হলে প্রতিটি ফ্লাইটে ৪–৬ ঘণ্টা সময় বেশি লাগবে।

  • এতে প্রতি ফ্লাইটে খরচ ৩০,০০০ থেকে ৬০,০০০ ডলার পর্যন্ত বেড়ে যাবে।

  • ইসরায়েলের জাতীয় বিমান সংস্থা এল-আল-এর আয় ৬০–৭৫% পর্যন্ত কমে যেতে পারে।

  • গবেষণাকেন্দ্রের ভাষায়, এটিও একটি “রক্ষণশীল অনুমান”—বাস্তবে ক্ষতি আরও বেশি হতে পারে।

 বাণিজ্য ও রপ্তানি

  • ইসরায়েলের অন্যতম রপ্তানি পণ্য যেমন হীরা, উচ্চমূল্যের প্রযুক্তিপণ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম—এসবই সময়-সংবেদনশীল। ফ্লাইট বিলম্ব হলে সরাসরি রপ্তানি ব্যাহত হবে।

  • এ কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বিকল্প উৎস খুঁজে নিতে পারে।

  • পর্যটনশিল্পও ভেঙে পড়বে, কারণ সরাসরি ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেলে ইউরোপ ও এশিয়ার পর্যটকরা সহজে আসতে পারবে না।


 রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব

 যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিধা

  • প্রতিবেদন অনুযায়ী, আকাশপথ অবরোধ হলে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের কূটনৈতিক সংকটে পড়বে।

  • একদিকে ইসরায়েলকে বাঁচাতে হবে, অন্যদিকে উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব রক্ষা করতে হবে।

  • ওয়াশিংটন যদি ইসরায়েলকেই প্রাধান্য দেয়, তবে আরব বিশ্বের আস্থা হারানোর ঝুঁকি থাকবে।

আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো

  • এ অবরোধের ফলে নতুন আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি হতে পারে।

  • উপসাগরীয় দেশগুলো হয়তো শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, চীন, রাশিয়া বা অন্য শক্তির সঙ্গে নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বৈচিত্র্যপূর্ণ করার পথে হাঁটবে।

 আব্রাহাম চুক্তির ভবিষ্যৎ

  • ২০২০ সালে ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছিল।

  • তবে গাজায় চলমান গণহত্যা ও দোহায় হামলার পর এসব দেশ ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে নিন্দা করেছে।

  • এখনো চুক্তি বাতিল বা স্থগিত করা হয়নি, কিন্তু কূটনৈতিক দূরত্ব বাড়ছে।


নিরাপত্তাগত প্রভাব

 আঞ্চলিক উত্তেজনা

  • আকাশপথ অবরোধ ভাঙতে ইসরায়েল যদি সামরিক পদক্ষেপ নেয়, তাহলে আঞ্চলিক সংঘাতের আশঙ্কা প্রবল হবে।

  • এতে ইরান ও ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোকেও সরাসরি জড়িয়ে পড়তে দেখা যেতে পারে।

 “গ্রে জোন” কৌশল

  • গবেষণাকেন্দ্র অবরোধকে বলছে “গ্রে জোন স্ট্র্যাটেজি”—অর্থাৎ এটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ নয়, আবার শান্তিপূর্ণ চাপও নয়; বরং মাঝামাঝি এমন এক পদক্ষেপ যা শত্রুকে দুর্বল করে।

  • এতে এক ফোঁটা রক্ত না ঝরিয়েও কার্যকর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব।

 আন্তর্জাতিক আইনগত প্রশ্ন

  • শিকাগো কনভেনশনের ৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী, আকাশপথ বন্ধ করা যায় কেবল সামরিক প্রয়োজন বা জননিরাপত্তার কারণে, তবে বৈষম্যমূলকভাবে নির্দিষ্ট কোনো দেশকে লক্ষ্য করা যাবে না।

  • তাই অবরোধকারীরা যুক্তি দেখাবে, ইসরায়েলের হামলা তাদের নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি।

  • তবে ইসরায়েল ও মিত্ররা এটিকে আন্তর্জাতিক আদালতে চ্যালেঞ্জ করবে।


নেতানিয়াহুর প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন—

  • দেশটি এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে “অন্তরিণ (isolated)” হয়ে পড়েছে।

  • তাই ইসরায়েলকে “স্বনির্ভর অর্থনীতি”র দিকে যেতে হবে।

  • তিনি ইসরায়েলকে একদিকে এথেন্সের মতো জ্ঞান–গবেষণার কেন্দ্র এবং অন্যদিকে “সুপার স্পার্টা”র মতো শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্র বানানোর ডাক দিয়েছেন।

  • নেতানিয়াহুর ভাষায়: “আমরা নিজেদের রক্ষা করব এবং শত্রুকে আঘাত করার সক্ষমতা অর্জন করব।”


সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা

সম্ভাবনা

  • যদি তুরস্ক, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া যোগ দেয়, তাহলে ইসরায়েলের এশিয়া ও আফ্রিকার বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

  • এতে দেশটির প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে থেমে যেতে পারে।

 সীমাবদ্ধতা

  • তবে বাস্তবে এমন সমন্বিত অবরোধের সম্ভাবনা কম।

  • কারণ এতে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হবে এবং অবরোধকারী দেশগুলোকেও অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।

  • এজন্য প্রতিবেদনটি এটিকে “কম সম্ভাবনাময়” হিসেবে চিহ্নিত করেছে।


আল হাবতুর রিসার্চ সেন্টারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সমন্বিত আকাশপথ অবরোধ ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

  • অর্থনীতিতে মন্দা, বাণিজ্যে ক্ষতি, পর্যটনে ধস নামবে।

  • রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও আরব অংশীদারদের মধ্যে দ্বিধা তৈরি হবে।

  • নিরাপত্তাগতভাবে নতুন সংঘাতের ঝুঁকি বাড়বে।

তবে এর বাস্তবায়ন কঠিন—কারণ অবরোধকারীরাও ক্ষতির মুখে পড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঝুঁকিতে পড়বে। তবুও এটি প্রমাণ করে দিয়েছে, আরব ও মুসলিম দেশগুলো চাইলে যৌথভাবে ইসরায়েলের ওপর “রক্ত ঝরানো ছাড়াই কার্যকর চাপ” সৃষ্টি করতে সক্ষম।

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531