ঢাকা,  শনিবার
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Advertisement
Advertisement

নীরব বিপ্লব: বাংলাদেশে ই-বাইকের উত্থান

প্রকাশিত: ১৪:৫৮, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আপডেট: ১৪:৫৮, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নীরব বিপ্লব: বাংলাদেশে ই-বাইকের উত্থান

ই-বাইকের উত্থান

ই-বাইক কেনার পর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আরিফুর রহমানের জীবনে এসেছে এক বড় পরিবর্তন। আগে যখন তিনি ১৫০ সিসির মোটরবাইক চালাতেন, তাঁর মেয়ে কান চেপে ধরত। এখন ই-বাইক চালালে হাসিমুখে হাত নেড়ে বিদায় জানায়, এমনকি চার্জ দিতে মনে করিয়ে দেয়—যেন এটি তার খেলনা।

এই ঘরোয়া পরিবর্তন আসলে বাংলাদেশের শহর ও শহরতলিতে এক বৃহৎ রূপান্তরের প্রতীক। ক্রমেই পেট্রলচালিত মোটরবাইক ছেড়ে শব্দহীন ই-বাইকের দিকে ঝুঁকছেন মানুষ।


আমদানি ও বাজার প্রবণতা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা গেছে, তিন বছরে ই-বাইক আমদানি চারগুণ বেড়েছে।

  • ২০২২–২৩ অর্থবছর: ২,৪৪৬টি ই-বাইক (মূল্য ৯ কোটি টাকা)

  • ২০২৪–২৫ অর্থবছর: ১০,০৫৩টি ই-বাইক (মূল্য ৪৭ কোটি টাকা)

বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীনা ব্র্যান্ড রিভো ও ইয়াদেয়া। স্থানীয়ভাবে প্রতিযোগিতায় নেমেছে ওয়ালটন, আকিজ ও রানার অটোমোবাইলস।

রিভোর বিপণন ব্যবস্থাপক ইনজামুল ইসলাম রিদম বলেন,
"মাত্র এক বছরে রিভো শীর্ষ ব্র্যান্ডে উঠে এসেছে। চাহিদা কেবল সস্তা বলে নয়, বরং এটি শহুরে জীবনের গতির সঙ্গে মানানসই বলে।"


কেন জনপ্রিয় হচ্ছে ই-বাইক?

প্রধান কারণ সাশ্রয়।

  • পেট্রলচালিত বাইকে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ২–৩ টাকা

  • ই-বাইকে খরচ মাত্র ১০–৩০ পয়সা

  • মাসে গড়ে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সাশ্রয়

রক্ষণাবেক্ষণও সহজ—ইঞ্জিন তেলের ঝামেলা নেই, খুচরা যন্ত্রাংশ কম লাগে।

রিদমের হিসাব অনুযায়ী,
"একটি ফুয়েল মোটরবাইক বছরে ৮০–৯০ হাজার টাকা খরচ করায়—যা প্রায় নতুন ই-বাইকের দামের সমান। অন্যদিকে ই-বাইকে মাসে বিদ্যুৎ খরচ ৩০০–৫০০ টাকার বেশি নয়। পাঁচ বছরে পার্থক্য দাঁড়ায় ৪ লাখ টাকারও বেশি।"


ব্যবহারকারীর ধরণ বদলাচ্ছে

তরুণ পেশাজীবী, নারী, গৃহিণী ও প্রবীণরা দ্রুত ই-বাইক গ্রহণ করছেন।
রিদমের ভাষায়, “এটি আর শুধু একটি বাইক নয়; বরং একটি জীবনযাত্রার পছন্দ।”

ঢাকার যাত্রী রুকসানা হোসেন বললেন,
"খরচ কমছে, পরিবেশের জন্যও ভালো। তাই স্কুটারের বদলে ই-বাইক বেছে নিয়েছি।"


সাংস্কৃতিক রূপান্তর

ই-বাইক এখন কেবল যানবাহন নয়, বরং আধুনিকতা ও পরিবেশবান্ধব জীবনের প্রতীক। দোকানদার আবুল কালাম জানালেন,
"আগে ই-বাইক কেউ খেয়ালই করত না। এখন ক্রেতারা দোকানে ঢুকেই ই-বাইক চান।"


চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে

সবচেয়ে বড় সমস্যা চার্জিং অবকাঠামো।

  • পূর্ণ চার্জে সময় লাগে ৭–৮ ঘণ্টা

  • দ্রুত চার্জিং সম্ভব ৪০ মিনিটে, কিন্তু চার্জিং স্টেশন অপ্রতুল

কালাম বললেন, “ক্রেতারা ভয় পান—হাইওয়েতে চার্জ শেষ হয়ে গেলে কী হবে?”

রিদম মনে করেন,
"ব্যাটারি সোয়াপিং নেটওয়ার্ক বা দ্রুত চার্জিং ব্যবস্থা এলে বাজার হঠাৎ বেড়ে যাবে। এক কাপ চা খাওয়ার সময়ের মধ্যেই চার্জ—এটাই ভবিষ্যৎ।”


নীতিমালা ও শিল্পের সম্ভাবনা

সরকার স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে কর ছাড় দিয়েছে। যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট ও অগ্রিম কর মওকুফ হয়েছে। ওয়ালটন ইতোমধ্যে দেশেই উৎপাদন শুরু করেছে।

ওয়ালটন ডিজি-টেকের কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান বলেন,
"একটি ই-বাইক ব্যবহার করলে পরিবার মাসিক জ্বালানি খরচ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে। দুই বছরে সাশ্রয় দিয়েই আরেকটি বাইক কেনা সম্ভব।"


পরিসংখ্যানের সীমাবদ্ধতা

বিআরটিএর তথ্যমতে, দেশে ৬৫ লাখ নিবন্ধিত গাড়ির মধ্যে ৪৭ লাখ মোটরসাইকেল। অথচ বৈদ্যুতিক বাইকের সংখ্যা মাত্র ২৬১টি। আরও হাজারো ই-বাইক চলছে অনিবন্ধিত অবস্থায়।


সামনে এগোনোর পথ

মোবাইল ব্যাংকিং যেমন একসময় প্রান্তিক থেকে মূলধারায় এসেছে, ই-বাইকও ঠিক সেভাবে ধীরে ধীরে ঘরে ঘরে প্রবেশ করছে।

আরিফুর রহমানের সহজ ব্যাখ্যা,
"মেয়ে খুশি, খরচ কমেছে, যাত্রা নীরব—আমার আর কী চাই?"

রিদমের মতে,
"ভবিষ্যৎ বৈদ্যুতিক। সরকার বা কোম্পানি নয়, ভোক্তারাই তা বেছে নিচ্ছেন। প্রতিটি নতুন রাইডার প্রমাণ করছে প্রযুক্তি কার্যকর। আর বিপ্লব শুরু হয় এভাবেই।"

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531