
প্রবাসীর মরদেহ
২০২৪ সালে প্রবাসে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা ছুঁয়েছে নতুন রেকর্ড। বছরের প্রথম ৫ মাসেই বিদেশ থেকে ৪ হাজার ৮১৩টি মৃতদেহ দেশে ফিরেছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৫.৭ শতাংশ বেশি। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৪,৫৫২।
রামরু পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে উদ্বেগজনক তথ্য—মৃতদের গড় বয়স মাত্র ৩৮ বছর। এই অকাল মৃত্যু শুধু সংখ্যা নয়, বরং অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের এক করুণ চিত্র।
মৃত্যু ঘিরে অস্বচ্ছতা ও প্রশ্ন
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীতে আয়োজিত "প্রবাসে মৃত্যু হওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিতকরণ" শীর্ষক সংলাপে রামরুর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন:
“বাংলাদেশ সরকার কখনোই মৃত অভিবাসীদের মৃত্যু সনদে উল্লেখিত কারণ যাচাই করতে ময়নাতদন্ত করে না। অনেক সময় দেহে আঘাতের চিহ্ন থাকলেও তা ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবে সনদে লেখা হয়।”
মৃত্যুর ধরন ও বিভাজন:
-
মোট মৃত্যুর ৬৯% ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
-
৩১% মৃত্যু ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ—যার মধ্যে রয়েছে:
-
দুর্ঘটনা
-
আত্মহত্যা
-
হত্যা
-
-
সৌদি আরবে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর হার: ২৪%
-
নারী অভিবাসীদের মৃত্যুর ৩২% ‘অস্বাভাবিক’ হিসাবে চিহ্নিত।
নারী অভিবাসীদের ঝুঁকি আরও বেশি
গবেষণা অনুযায়ী, উপসাগরীয় ও আরব দেশগুলোতে কাজরত নারী অভিবাসীদের গড় মৃত্যু বয়স ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ১০ বছর কম। এতে স্পষ্ট হয়, অসহনীয় কাজের পরিবেশ, নির্যাতন ও সুরক্ষা হীনতাই নারী শ্রমিকদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
এছাড়া নিহত নারী অভিবাসীদের ৪৮ শতাংশ পরিবারের সদস্য সরকারি মৃত্যুসনদে উল্লিখিত কারণকে অবিশ্বাস করেন।
মরদেহ ব্যবস্থাপনায় অবমাননা ও ভোগান্তি
রামরু’র গবেষণায় আরও উঠে এসেছে কিছু গভীরতর নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা:
-
ঢাকার বিমানবন্দরে ফেরত আসা মৃতদেহের প্রতি অসৌজন্যমূলক ও অসম্মানজনক আচরণ করা হয়।
-
মরদেহ গ্রহণে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে ৮০ শতাংশ পরিবার প্রশাসনিক জটিলতা ও হয়রানির শিকার হন।
? সুপারিশ ও অগ্রাধিকার
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসী শ্রমিকদের মর্যাদা ও মৃত্যুর কারণ তদন্তে অবিলম্বে নিচের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে:
-
সরকারিভাবে ময়নাতদন্ত ও মৃত্যুর কারণ যাচাইয়ের বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া চালু করা।
-
আন্তর্জাতিক মান অনুসারে মৃত্যুর কারণ শ্রেণিবদ্ধকরণ।
-
বিমানবন্দরে মরদেহের প্রতি সম্মানজনক আচরণ ও মর্যাদাপূর্ণ গ্রহণ নিশ্চিত করা।
-
আহত বা নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরত আসা শ্রমিকদের জন্য পুনর্বাসন ও ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থার গঠন।
উপসংহার
প্রবাসী শ্রমিকেরা দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলেও, তাদের মৃত্যু নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের উদাসীনতা নির্লজ্জ বাস্তবতা হয়ে উঠছে। রামরুর গবেষণা একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়—সংখ্যার পেছনে আছে হারিয়ে যাওয়া জীবন, স্বপ্ন ও পরিবার। আর তা রক্ষা করা এখনই সময়।