
ব্যাংকে আমানত
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে বিদেশি মুদ্রায় আমানতের পরিমাণ হঠাৎ করেই চোখে পড়ার মতোভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত এক বছরে ব্যাংকগুলোর বিদেশি মুদ্রার আমানত প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দেশি মুদ্রার আমানতের তুলনায় বিদেশি মুদ্রা জমার এই অস্বাভাবিক উত্থান অর্থনীতির একটি নতুন ধারা নির্দেশ করছে।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকেই বাড়তি গতি
২০২৩ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই দেশে ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রা জমার হার নাটকীয়ভাবে বাড়তে শুরু করে। রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান, নীতিনির্ধারকদের কিছু উদার পদক্ষেপ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রণোদনামূলক সুবিধার কারণে এই পরিবর্তন এসেছে।
বিশেষ করে আবাসিক বৈদেশিক মুদ্রা আমানত (আরএফসিডি) ও ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টে (এফসিএ) সুদ ও অতিরিক্ত সুবিধা চালুর পর মানুষ ঘরে জমিয়ে রাখা ডলার ও অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা আবার ব্যাংকে রাখতে শুরু করেছে।
বিদেশিদের জমা অর্থ দ্বিগুণ
বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিরা ব্যাংকে যে "টাকায় রূপান্তরযোগ্য হিসাব" (Convertible Taka Account) খুলে থাকেন, তাতে এক বছরে জমা অর্থ দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চে যেখানে এই হিসাবগুলোতে ১,৮০৪ কোটি টাকা ছিল, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৩,৮৫৯ কোটি টাকা।
এফসিএ হিসাবেও বিপুল উত্থান
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যুক্ত প্রতিষ্ঠান ও প্রবাসীদের খোলা বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব—এফসিএতেও জমার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। ২০২৪ সালের মার্চে এই ধরনের হিসাবগুলোতে জমা ছিল ৬,০৫৪ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা, যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে গিয়ে পৌঁছায় ১৪,৭৫০ কোটিতে।
আরএফসিডি হিসাবেও বড় উত্থান
বিদেশ সফর শেষে দেশে ফেরত আসা বাংলাদেশিদের আরএফসিডি হিসাবেও আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এক বছরে এ ধরনের হিসাবগুলোতে জমা বেড়েছে ২৬,১৩০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৩,২৭৩ কোটি টাকা।
বিপরীতে দেশি মুদ্রার আমানত প্রায় স্থির
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশের ব্যাংক খাতে ২০২৪ সালের মার্চে মোট আমানত ছিল ১৭ লাখ ৬২ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের মার্চে তা বেড়ে হয় ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে প্রবৃদ্ধি মাত্র ১.০৯ শতাংশ—যা বিদেশি মুদ্রার আমানতের দ্বিগুণ প্রবৃদ্ধির তুলনায় অনেক কম।
কেন বাড়ছে বিদেশি মুদ্রায় আগ্রহ?
-
সুদ সুবিধা: বাংলাদেশ ব্যাংক আরএফসিডি হিসাবের উপর সুদ চালু করার পাশাপাশি কিছু ব্যাংক এই খাতে প্রতিযোগিতামূলক সুদ দিচ্ছে।
-
মুক্ত খরচ সুবিধা: আরএফসিডি থেকে হিসাবধারী বা নির্ভরশীল ব্যক্তি বিদেশে ভ্রমণ, শিক্ষা বা চিকিৎসার জন্য খরচ করতে পারছেন, কোনো নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা ছাড়াই।
-
বৈচিত্র্যময় মুদ্রা: ডলার, ইউরো, পাউন্ড, ইয়েন ছাড়াও এখন অস্ট্রেলিয়ান ডলার, কানাডিয়ান ডলার, সিঙ্গাপুরি ডলারেও এসব হিসাব খোলা যাচ্ছে।
-
প্রবাসীদের জন্য উন্মুক্ত সুবিধা: প্রবাসীদের নামে খোলা বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে এখন বাজারভিত্তিক সুদের হার কার্যকর, ফলে ব্যাংক-গ্রাহক আলোচনার ভিত্তিতে উচ্চ সুদের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।
বিনিয়োগ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে
অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু পদক্ষেপ এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধির ফলে বিদেশি মুদ্রার প্রবাহ বাড়ছে। চীনের বিনিয়োগকারীদের দেশে আসাও অন্যতম একটি কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশেষজ্ঞের মত
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন,
“ব্যাংকে ডলার জমা রাখলে এখন সুদ পাওয়া যায়, পাশাপাশি কোনো ঝামেলা ছাড়াই বিদেশে খরচের সুযোগ রয়েছে। তাই যারা নিয়মিত বিদেশে যাতায়াত করেন, তারাও এখন এই হিসাব ব্যবহার করছেন। এটা আমাদের ব্যাংক খাতের জন্য ইতিবাচক।’’
বিদেশি মুদ্রায় ব্যাংক আমানতের এই প্রবল উত্থান স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, মানুষ এখন অর্থের নিরাপত্তা ও লিকুইড সুবিধা দুই-ই চাইছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এই গতি যেমন অর্থনীতির জন্য স্বস্তির, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য আরও স্থিতিশীল আর্থিক নীতির প্রয়োজনীয়তাও সামনে নিয়ে আসে।