
শরণার্থী
বিশ্বজুড়ে আশ্রয়প্রার্থীর তালিকায় বাংলাদেশিদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা—এসব পরিচিত গন্তব্য ছাড়িয়ে এবার চমক হিসেবে নতুন করে উঠে এসেছে আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র সোমালিয়ার নাম। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০২৩ সালে ২৮ হাজার ৪৭৩ জন বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন। এর বাইরেও আরও ১ লাখ ৮ হাজার ১৩১ জন বাংলাদেশি জাতিসংঘের কাছে শরণার্থীর মর্যাদা চেয়ে আবেদন করেছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সংখ্যার বৃদ্ধির প্রবণতা পরিস্কার। ইউএনএইচসিআরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে যেখানে প্রায় ১৯ হাজার বাংলাদেশি আবেদন করেছিলেন, সেখানে ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা প্রায় দেড় লাখের কাছাকাছি। ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছরই এই সংখ্যা বাড়ছে—যা আন্তর্জাতিক মহলের জন্যও এক প্রকার উদ্বেগের ইঙ্গিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ এবং নাগরিক অধিকার নিয়ে অসন্তোষ—এসব কারণেই বাংলাদেশিদের মধ্যে বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতা বাড়ছে। অনেকেই বৈধ পন্থায় যাওয়ার সুযোগ না পেয়ে শরণার্থী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন, যার মধ্যে সোমালিয়ার মতো অনিরাপদ ও যুদ্ধাহত দেশও এবার যুক্ত হয়েছে। ২০২৩ সালে শুধু সোমালিয়াতেই ৬ জন বাংলাদেশি শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন—যা এই ট্রেন্ডের অস্বাভাবিক বিস্তারকেই নির্দেশ করে।
অন্যদিকে, দেশের ভেতরেই আরেকটি জটিল বাস্তবতা দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে—রোহিঙ্গা সংকট। কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে এখন প্রায় ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনারের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিনই ক্যাম্পে বাড়ছে জনসংখ্যা। জন্মহার যেমন বেড়েছে, তেমনি নতুন করে মিয়ানমার থেকেও রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে সীমান্ত পেরিয়ে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সহায়তা দিন দিন কমে যাচ্ছে—ফলে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে।
এই পরিস্থিতি নিয়ে কমিশনার সতর্ক করে বলেন, “দ্রুত প্রত্যাবাসনের কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এই সংকট শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।”
বিশ্লেষকদের মতে, একদিকে বাংলাদেশিদের বিদেশমুখী হওয়া, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ শরণার্থী চাপ—এই দুই বিপরীতমুখী বাস্তবতা বাংলাদেশকে এক সংকটজনক দ্বিমুখী চাপে ফেলে দিয়েছে। এখনই কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা না বাড়ালে এই সংকট আগামীতে আরও বিস্তৃত আকার নিতে পারে।