ঢাকা,  শনিবার
২৭ জুলাই ২০২৪

Advertisement
Advertisement

মৃত্যুর সাতশ বছর পরেও মহাবিশ্বে প্রভাব ফেলে তার সৃষ্টিকর্ম

প্রকাশিত: ১৯:০৮, ১ নভেম্বর ২০২৩

আপডেট: ১৯:০৮, ১ নভেম্বর ২০২৩

মৃত্যুর সাতশ বছর পরেও মহাবিশ্বে প্রভাব ফেলে তার সৃষ্টিকর্ম

কবি হাফিজ

মহাকালের মহাকবি হাফিজ শিরাজী। যিনি কবি হাফিজ নামেই পরিচিত। প্রায় সাতশ বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এখনও ইরানের প্রায় প্রতিটি ঘরে হাফিজের কবিতার বইগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়া হয়। তার লেখনিতে অভিভূত মোহবিষ্ট হয়ে পড়ে লাখো মানুষ। গভীরভাবে আলোড়িত হয় তাদের মন আর চিন্তা-চেতনা।

আধ্যাত্মিক এই সাধক পুরুষটির কবিতা গজলের লাইনে লাইনে কুরআনের প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। তার ঐশী প্রেমের তীব্রতা আর আকুতি আজও আল্লাহর প্রতি মানুষের সুপ্ত ভালোবাসাকে জাগিয়ে তোলে। ইরানের মানুষ তাকে ভালোবেসে শিরাজেরবুলবুলিবলে ডাকেন।

হাফিজ কবর দেয়া হয় ইরানের শিরাজের হাফিজিয়া নামের জায়গায়। ওই এখন ইরানসহ বিশ্বের অনেকের কাছে চরম ভক্তির একটি স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ওই স্থানের আসেন মাজার জিয়ারত করতে। গভীর শ্রদ্ধা আর আবেগে চোখের পানি ফেলেন। নিজের ভবিষ্যৎ জানতে আর মনের গভীরে জেগে উঠা প্রশ্নের জবাব পেতে অনেকে ছুটে আসেন তার সমাধিতে। কেউ কেউ পাতা উল্টে পড়তে শুরু করেন তার সৃষ্টিকর্ম। মহাকবি হাফিজ কাউকেই নিরাশ করেন না। শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ নারী-পুরুষ যে যার মতো উত্তর পেয়ে যায় হাফিজের সমাধি আর সৃষ্টিকর্ম থেকে। 

তার কালজয়ী সৃষ্টি দেবান--হাফিজ ইরানের মানুষকে আজও পথ দেখায়। দেশটির উচ্চবিত্ত থেকে দরিদ্রকবলিত এলাকা, জনবহুল রাজধানী তেহরান থেকে শুরু করে নিরিবিলি খোরাসন অঞ্চল, বিস্তৃত মরুভূমি ইয়াজড থেকে শুরু করে গভীর অরণ্য মাজানদারান সব জায়গায় ধ্বনিত হয় হাফিজের কবিতা। মহাকবি জালালুদ্দীন রুমি, মহাকবি শেখ সাদীর চেয়েও ভিন্নভাবে ইরানি মানুষ স্বরণ করেন হাফিজকে। 

শুধু মুসলিম বিশ্ব নয় পশ্চিমা বিশ্বের মহান কবি, সাহিত্যিক দার্শনিকদের কাছে এখন চিন্তার জগতে হাফিজের সৃষ্টিকর্মের গভীর প্রভাব ফেলে।  যা তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেছেন।

জার্মানির জাতীয় কবি গেটে মহাকবি হাফিজ পাঠে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে গেটে তাকে `জোড়ভাই` বলে উল্লেখ করেছেন। ১৮১২ সালে জার্মান ভাষায় প্রথম অনূদিত হয় হাফিজের সৃষ্টিকর্ম। সেই সময় ৬৫ বছর বয়সী গেটে হাফিজের অনূদিত লেখা পড়ে অভিভূত মোহবিষ্ট হয়ে পড়েন।

হাফিজ তার জীবদ্দশায় ইসলামি বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিলেন, তখন থেকে ব্যাপক বিস্তৃত অঞ্চলের কবি, গীতিকার, সাহিত্যিকদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন। তার গান, কবিতা, গজল ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গীত পঠিত হয়ে থাকে।

পাশ্চাত্যের কবি সাহিত্যিকের কাছে অতি শ্রদ্ধেয় মহাকবি হাফিজের আসল নাম শামসুদ্দীন মোহাম্মদ। তিনি কুরআনের হাফেজ ছিলেন বলেই মূল  নামটি চাপা পড়ে এবং তিনিহাফিজনামেই পরিচিতি হন। ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে শিরাজের মোসাল্লা নামক স্থানে চতুদর্শ শতাব্দীর শুরুর দিকে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বহু বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক কীর্তিমান ব্যক্তিত্বের জন্মস্থান এই শিরাজ।

হাফিজের মৃত্যুর একশ বছরের মধ্যেও তার কোনো জীবনী রচিত হয়নি বলে তার জন্ম-মৃত্যুর দিনক্ষণ জীবনের অনেক ঘটনাই সাধারণের অগোচরে থেকে গেছে। জানা যায় তার বাবা বাহাউদ্দীন ইস্পাহানি নগরী থেকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে শিরাজে এসে বসতি গড়েন। বাবার মৃত্যুতে হাফিজ তার মা কঠিন আর্থিক সমস্যায় পড়েন। তাই ছোট বয়সেই তাকে রুটির দোকানে কাজ করে সংসার চালাতে হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে হাফিজের বড় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি সরাসরি ফার্সি ভাষা থেকে হাফিজের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। তিনি যখন রুবাইয়াত--হাফিজ অনুবাদ করছিলেন, তখন তার ছেলে মৃত্যু শয্যায়। তাই তো নজরুল বলেছেন-‘যে পথ দিয়ে আমার পুত্রের শবযান চলে গেল, সে পথ দিয়েই এলেন প্রিয়তম কবি হাফিজ

ভারতের জোড়াসাকোঁর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারও ছিল পারস্যের কবি সাহিত্যিকদের ভিষণ ভক্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি হাফিজের এমনই ভক্ত ছিলেন যে প্রতিদিন সূর্য উঠার সময় সূর্যের দিকে মুখ করে হাফিজের কবিতা পড়তেন।

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী হাফিজের সমাধি পাশে বসে নীরবে অশ্রু ফেলেছেন।  বলা হয়ে থাকে, মহারানী ভিক্টোরিয়া সমস্যা উত্তরণে কখনো কখনো হাফিজের লেখনির শরণাপন্ন হতেন

মহান এই কবির সাহিত্য কর্ম ইংরেজিতে প্রথম অনূদিত হয় ১৭৭১ সালে। এর আগে ইউরোপ উত্তর আমেরিকায় হাফিজের তেমন কোনো পরিচিতি ছিল না। উইলিয়াম জোনসের অনুবাদ পাশ্চাত্যের কালজয়ী লেখক থোরো , গেটে, রালফ ওয়ালডো এমারসনের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

মহাকবি হাফিজের প্রতি জার্মানির জাতীয় কবি গেটের অসাধারণ শ্রদ্ধার কারণে হাফিজও জার্মান জনগণের কাছে ভালোবাসার মানুষে পরিণত হন। হাফিজ বা গেটে কেউই পৃথিবীতে নেই। তবুও দুমহান ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানাতে গেটের জন্মস্থান ওয়েমার সিটিতে একটি মনুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে। যেখানে একটি গ্রানাইট পাথরখণ্ড কেটে মুখোমুখি দুটি চেয়ার বানানো হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রখ্যাত এই দুকবির আত্মিক ঘনিষ্ঠতাকে তুলে ধরা হয়েছে।

বলা হচ্ছে, সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতিতে জন্ম, পৃথিবীর দুপ্রান্তের দুবিখ্যাত কবি সামনাসামনি বসে পূর্ব পশ্চিম নিয়ে আলোচনা করছেন। যদিও দুজনের পৃথিবীতে আসা, চিরবিদায়ের সময় দুদেশের ভৌগলিক দূরত্বের ব্যবধান যথাক্রমে কয়েক শত বছর হাজারো মাইল। ২০০০ সালে যৌথভাবে মনুমেন্টের উদ্বোধন করেন ইরান জার্মানির সরকারপ্রধান।

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /mnt/volume_sgp1_05/p1kq0rsou/public_html/details.php on line 531