ঢাকা,  বৃহস্পতিবার
০৩ জুলাই ২০২৫

Advertisement
Advertisement

ফেসবুকে ‘অ্যাড দেখে ইনকাম’ প্রতারণা: মাসে ১০ হাজার টাকার লোভে কলেজশিক্ষার্থীসহ অসংখ্য ভুক্তভোগী

প্রকাশিত: ১৬:০৪, ২ জুলাই ২০২৫

ফেসবুকে ‘অ্যাড দেখে ইনকাম’ প্রতারণা: মাসে ১০ হাজার টাকার লোভে কলেজশিক্ষার্থীসহ অসংখ্য ভুক্তভোগী

ফেসবুক

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার এক কলেজশিক্ষার্থী প্রতিদিন ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে মাসে ১০ হাজার টাকা আয়ের প্রলোভনে পড়ে এক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। গত মাসে ফেসবুকে প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপন থেকে তিনি একটি ওয়েবসাইটের খোঁজ পান, যেখানে বলা হয়, প্রতিদিন ঘরে বসে বিজ্ঞাপন দেখে আয় করা যাবে। তবে শর্ত হিসেবে শুরুতে ওয়েবসাইটে ১০ হাজার টাকা জমা করতে বলা হয়।

প্রতারণাকারীদের ফাঁদে পা দিয়ে ওই শিক্ষার্থী মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)-এর মাধ্যমে টাকা পাঠান। কয়েক দিন বিজ্ঞাপন দেখার পর হঠাৎ তার অ্যাকাউন্ট ‘ব্লক’ করে দেওয়া হয় এবং নতুন করে আরও পাঁচ হাজার টাকা দাবি করা হয়। সন্দেহ হলে তিনি বন্ধুদের মাধ্যমে অনুসন্ধান করে জানতে পারেন, এটি একটি প্রতারণামূলক ওয়েবসাইট। এক সপ্তাহ চেষ্টার পরও নিজের জমা দেওয়া অর্থ আর ফেরত পাননি তিনি।

প্রতারণার একই কৌশল, ভিন্ন ভিন্ন রূপ
এই ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন নয়। অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাব–এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুকে ‘অ্যাড দেখে ইনকাম’ বা ‘ইনকাম ওয়েবসাইট’ নামে চলমান বিজ্ঞাপনগুলো আসলে প্রতারণার ফাঁদ। গবেষণায় দুই দিনে অন্তত ৩১টি পেজ থেকে এ ধরনের বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে এবং ২৫টি প্রতারণামূলক ওয়েবসাইট চিহ্নিত হয়েছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, এ সব ওয়েবসাইটের লেআউট প্রায় একই রকম—একটি বৃত্তাকার লোগো, নিচে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের লোগো এবং ভুয়া কর্মসূচি। এর মধ্যে ২৩টি ওয়েবসাইটে একই ধরনের আইকন দেখা গেছে, যা নিশ্চিত করে যে একটি নির্দিষ্ট সংঘবদ্ধ চক্র এসবের পেছনে রয়েছে। বেশিরভাগ ওয়েবসাইট একই সময়সীমায় (২০২৫ সালের এপ্রিল-মে) নিবন্ধিত হয়েছে, একই রেজিস্ট্রার ও হোস্টিং সেবাদাতা ব্যবহার করেছে, এমনকি এক আইপি ঠিকানাও ব্যবহার করেছে অনেক ওয়েবসাইট।

কীভাবে প্রতারণা চালানো হয়?
‘ইটস লিয়ান’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে ছড়ানো একটি ভিডিওতে বলা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতিদিন ২০০–৫০০ টাকা আয় করা সম্ভব। তবে এই আয়ের জন্য ব্যবহারকারীকে একটি প্যাকেজ কিনতে হয়—যেমন ৫০০ টাকা জমা দিয়ে প্রতিদিন ২০০ টাকা আয় কিংবা ১ হাজার টাকা জমা দিয়ে ৪০০ টাকা আয়। সবকিছুই মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

ইউটিউবারদের ভিডিও দিয়ে বিভ্রান্তি
ডিসমিসল্যাব আরও জানায়, এসব ভিডিওর শুরুতে জনপ্রিয় ইউটিউবারদের ভিডিও ক্লিপ জুড়ে দেওয়া হয়, যাদের ইউটিউব চ্যানেলে ৪০ লাখেরও বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। ভিডিওর ওই অংশে ইউটিউবাররা মূলত ফেসবুকে ভিডিও বানিয়ে আয়ের কথা বললেও, বিজ্ঞাপনে তা কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তারা ওই প্রতারণামূলক ওয়েবসাইটেরই প্রচারণা চালাচ্ছেন।

ভুয়া ইতিবাচক মন্তব্যের বন্যা
এসব প্রতারণামূলক পেজের পোস্টে হাজারো ইতিবাচক মন্তব্য দেখা যায়। তবে ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে জানায়, এই মন্তব্যগুলোর ৭৯ শতাংশই ভুয়া। বারবার একই মন্তব্য ঘুরেফিরে বিভিন্ন ভুয়া প্রোফাইল থেকে দেওয়া হচ্ছে—যেমন: ‘আমি ৫০০০ টাকা মেম্বারশিপ ৩ দিন আগে অ্যাকটিভ করলাম। এখন পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছি।’ এসব ভুয়া প্রোফাইলে পোস্ট নেই, বন্ধু সংখ্যা ৫০-এর নিচে এবং বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।

ফেসবুক নীতিমালার লঙ্ঘন
গবেষণায় বলা হয়েছে, এই ধরনের প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন মেটার (ফেসবুকের মূল কোম্পানি) কমপক্ষে দুটি নীতিমালা লঙ্ঘন করছে। তবে মেটা এসব শনাক্ত ও বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলেই অভিযোগ উঠেছে।

ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাবই মূল কারণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, ডিজিটাল যুগে এমন প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে হলে ডিজিটাল সাক্ষরতা থাকা জরুরি। সাধারণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা না থাকায় শিক্ষিতরাও প্রতারিত হচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের প্রতারণা রোধে ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা যেমন দরকার, তেমনি প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে জনসচেতনতামূলক প্রচার।’

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এস এম আলতাফ হোসেন বলেন, এটি সুসংগঠিত প্রতারকচক্রের কাজ। তাদের পেজে ইতিবাচক মন্তব্যগুলোও ভুয়া, যা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে।

দিন দিন ঘরে বসে আয় করার লোভ দেখিয়ে মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত এই ধরনের প্রলোভনমূলক বিজ্ঞাপন সম্পর্কে সচেতন না হলে প্রতারণার শিকার হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ—ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা, রাষ্ট্রীয় তদারকি এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোর কঠোর নীতিমালার প্রয়োগ।

Advertisement
Advertisement

আরো পড়ুন  


Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531