
গুম কমিশন
গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে পানি ঢালা—নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা, যেন পানিতে ডুবে যাচ্ছেন! ভয়, আতঙ্ক, শ্বাসরোধের যন্ত্রণায় কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতেন। এই ভয়ংকর নির্যাতনের নাম ‘ওয়াটারবোর্ডিং’। আর এ নির্যাতন ছিল বাংলাদেশে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ওপর নিয়মিতভাবে চালানো পদ্ধতির একটি।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে (‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’) উঠে এসেছে র্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোপন বন্দিশালায় চালানো অমানবিক নির্যাতনের ভয়াবহ সব চিত্র। প্রায় ১,৮৫০টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ২৫৩ জন গুমভুক্ত ব্যক্তির তথ্য বিশদভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।
নিয়মিত নির্যাতনের তালিকা:
ভুক্তভোগীদের জবানিতে জানা গেছে—
-
ওয়াটারবোর্ডিং ছিল নিয়মিত চর্চা; এক তরুণের ভাষায়, “মুখে গামছা দিয়ে জগভর্তি পানি ঢালত, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত।”
-
দিনের পর দিন ছোট, অন্ধকার, দুর্গন্ধময় সেলে বন্দী রাখা হতো। খাওয়ার জায়গা ও টয়লেট একসঙ্গে। টয়লেট ব্যবহারের সময়ও সিসি ক্যামেরায় নজরদারি চলত।
-
ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসিয়ে জোরে ঘোরানো হতো, যাতে কেউ বমি করতেন, কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতেন।
-
নারীরা ছিলেন আরও বেশি অপমানজনক ও যৌন নিপীড়নমূলক নির্যাতনের শিকার।
বৈদ্যুতিক শক ও ঘুমের বঞ্চনা
র্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও সেলে আটককৃতদের মারধরের সময় মাঝেমধ্যে প্রস্রাব করার সুযোগ দেওয়া হতো—ঠিক সেই সময়েই বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। একজন ভুক্তভোগীর ভাষায়, “প্রস্রাব করার সঙ্গে সঙ্গে মনে হতো আমি পাঁচ ফিট ওপরে উঠে গেছি।”
একজন দীর্ঘ ৩৯১ দিন আটক থাকা ভুক্তভোগী জানান, ঘুমাতে দেওয়া হতো না। শীতে কম্বল-বালিশ সরিয়ে নেওয়া হতো, মশা কামড়ালেও মারতে পারতেন না।
মানসিক নির্যাতন ও দীর্ঘমেয়াদি ট্রমা
নির্যাতনের পাশাপাশি আটককৃতদের ওপর তৈরি হতো চরম মানসিক চাপ। খাবার কম দেওয়া, দীর্ঘ একাকীত্ব, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা ভুক্তভোগীদের মানসিকভাবে ভেঙে দিত। মুক্তির পর বহু ভুক্তভোগী মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন।
একজন বাবা জানান, তাঁর অপহৃত ১৬ বছর বয়সী ছেলে ২০ মাস পর ফিরে এলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। “সে হঠাৎ রেগে ওঠে, কথা জিজ্ঞেস করলে থাপ্পড় দেয়, একা একা হাসে... এখন ওর মুখ থেকে কোনো ঠিকমতো কথা বের হয় না।”
দায়মুক্তি ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ গুম ও অপহরণের ঘটনা কোনো লিখিত নথিপত্র ছাড়া হয়েছে। ফলে, নির্যাতনের দায় থেকে সহজেই বাঁচতে পেরেছে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলো। নির্যাতনের চিহ্ন গোপনে ব্যবহার করা হয়েছে ওষুধ বা মলম। বিচারপ্রক্রিয়ায় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ প্রায়শই উপেক্ষিত হয়েছে।
কমিশনের মন্তব্য
গুম কমিশনের সদস্য মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “ভুক্তভোগীদের না শুনলে এই নির্যাতনের মাত্রা কল্পনাও করা যেত না। মৃতপ্রায় অবস্থায় পৌঁছানো পর্যন্ত নির্যাতন চালানো হতো। এমন কোনো নির্যাতনের পদ্ধতি নেই, যা প্রয়োগ করা হয়নি।”
এই রিপোর্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে বলপূর্বক গুম ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের এক নির্মম দলিল হয়ে উঠেছে। মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রশ্নে এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে গভীরভাবে আলোচনার দাবি রাখে।