
গাজা
গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে পরিচালিত বিতর্কিত মানবিক সহায়তা সংস্থা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর বিরুদ্ধে ভয়াবহ অভিযোগ এনেছেন সংস্থাটির এক সাবেক নিরাপত্তা ঠিকাদার। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, তিনি একাধিকবার তার সহকর্মীদের মেশিনগান ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র ও ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালাতে দেখেছেন—যারা কোনোভাবেই হুমকি ছিলেন না।
সাক্ষাৎকারে ওই ঠিকাদার বলেন, একবার নারী, শিশু ও বয়স্ক ফিলিস্তিনিদের একটি দল ধীরে হাঁটার কারণে যখন ত্রাণকেন্দ্র থেকে ফিরে যাচ্ছিল, তখন এক নিরাপত্তারক্ষী ওয়াচটাওয়ার থেকে তাদের ওপর মেশিনগান দিয়ে গুলি চালান। তিনি আরও বলেন, এক সহকর্মী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ১৫-২০টি গুলি চালান একটি ভিড়ের মধ্যে, আরেক সহকর্মী তখন ঠাট্টা করে বলেন, "দারুণ, মনে হচ্ছে তুমি কাউকে মেরে ফেলেছো।" এরপর তারা এ ঘটনা নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকেন।
জিএইচএফ এসব অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছে। এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, “জিএইচএফ’র ত্রাণকেন্দ্র থেকে কখনো কোনো বেসামরিক নাগরিকের ওপর গুলি চালানো হয়নি।” তারা আরও দাবি করেছে, অভিযোগকারী একজন ‘অসন্তুষ্ট’ ও ‘অসদাচরণে লিপ্ত’ সাবেক ঠিকাদার, যাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।
তবে ওই ঠিকাদার তা অস্বীকার করে জানান, তিনি সম্মানজনকভাবে চাকরি ছেড়েছেন এবং সেই সংক্রান্ত প্রমাণ তার কাছে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, “জিএইচএফ-এর কার্যক্রমে কোনো নিয়ম-কানুন ছিল না। আমাদের বলা হতো—যদি হুমকি মনে হয়, তাহলে গুলি করো, মেরে ফেলো—পরে প্রশ্ন করো।”
সাবেক ঠিকাদার অভিযোগ করেন, গাজার ফিলিস্তিনিদের তারা ‘জম্বির ঝাঁক’ হিসেবে ডাকতেন, অর্থাৎ তাদের জীবন মূল্যহীন হিসেবে দেখা হতো। তিনি জানান, ত্রাণকেন্দ্রগুলোর পরিবেশ এতটাই নৃশংস ছিল যে ফিলিস্তিনিদের উপর নিয়মিতভাবে স্টান গ্রেনেড ছোড়া হতো, পিপার স্প্রে ব্যবহার করা হতো, এমনকি কেউ কেউ ভিড়ের চাপে কাঁটাতারে পড়ে গুরুতর আহত হতেন।
তিনি জানান, এক ঘটনায় একজন নারীর মাথায় স্টান গ্রেনেডের ধাতব অংশ আঘাত হানে। তিনি তাৎক্ষণিক মাটিতে পড়ে যান এবং নিস্তেজ হয়ে পড়েন। আরেকবার এক পুরুষের মুখে পুরো একটি পিপার স্প্রের ক্যান ঢেলে দেওয়া হয়।
জাতিসংঘ, স্থানীয় চিকিৎসক এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা জানায়, জিএইচএফ কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে অন্তত ৪০০’র বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। এসব কেন্দ্র স্থাপনকে কেন্দ্র করে শুরু থেকেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে জিএইচএফ, কারণ বহু ফিলিস্তিনিকে সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্র পেরিয়ে কয়েকটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রে যেতে বাধ্য করা হচ্ছিল।
ইসরায়েল দাবি করেছে, এ ব্যবস্থার ফলে হামাসের হাতে ত্রাণ পৌঁছানো বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে। জিএইচএফ দাবি করেছে, তারা ইতোমধ্যে পাঁচ সপ্তাহে ৫ কোটি ২০ লাখ খাবারের প্যাকেট বিতরণ করেছে। তবে সমালোচকরা বলছেন, এটি একটি ‘মরুভূমিতে বিষাক্ত জলকূপ’—যা মানবিক সহায়তার নামে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কৌশল মাত্র।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা অক্সফাম, সেভ দ্য চিলড্রেন সহ ১৭০টির বেশি সংস্থা একযোগে জিএইচএফ-এর কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানিয়েছে। তারা বলছে, ইসরায়েলি বাহিনী ও সশস্ত্র ঠিকাদাররা নিয়মিতভাবে ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালায়, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার জেরে ইসরায়েল গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত অন্তত ৫৭ হাজার ১৩০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে বিতর্কিত ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীলতা এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। পরিস্থিতির উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্রুত হস্তক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।