
মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু
স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় দুর্নীতি ও লুটপাটের প্রসঙ্গ উঠলেই মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর নাম সামনে আসে। সদ্য গ্রেপ্তার হওয়া এই ঠিকাদার দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বাস্থ্য খাতকে কার্যত জিম্মি করে রেখেছিলেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিনি একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির অন্যতম বড় সিন্ডিকেট তৈরি করেন।
সিন্ডিকেটভিত্তিক দুর্নীতি
অভিযোগ রয়েছে, মিঠু ও তার চক্রের নির্দেশেই হাসপাতালগুলোর জন্য বরাদ্দ নির্ধারণ করা হতো। অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে, যার দাম প্রকৃত মূল্যের ৮–১০ গুণ পর্যন্ত বেশি ধরা হয়েছিল।
-
মুগদা জেনারেল হাসপাতাল (২০১৬–১৭): মিঠুর স্ত্রীর প্রতিষ্ঠান ফিউচার ট্রেড ৮৬ কোটি টাকার বেশি কাজের আদেশ পায়। এর মধ্যে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। একটি মেডিকেল ল্যাবরেটরি-ডিপ ফ্রিজার ১৫–২০ লাখ টাকার হলেও ৭০ লাখ টাকায় কিনতে বাধ্য করা হয়েছিল। আজও সেই যন্ত্র অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে।
-
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: একটি বেবি স্কেলারের প্রকৃত দাম ৭,৫০০ টাকা হলেও, নষ্ট হওয়ার পর মেরামতের বিল দেখানো হয় ৪,১১,৯০০ টাকা। ওই টাকায় ৫০টিরও বেশি নতুন যন্ত্র কেনা যেত।
এ ছাড়া, নকল ব্র্যান্ডের স্টিকার লাগানো, পুরোনো বা রিকন্ডিশন্ড যন্ত্র নতুন বলে সরবরাহ করা এবং অনেক ক্ষেত্রে সরঞ্জাম সরবরাহ না করেও কোটি কোটি টাকা বিল উত্তোলনের অসংখ্য প্রমাণ মিলেছে।
দুদকের অনুসন্ধান ও সম্পদের খোঁজ
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে মিঠুর নামে–বেনামে প্রায় ১৪৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা মূল্যের সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে দুদকের ধারণা, বাস্তবে তার মালিকানায় হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে।
-
কাগজে-কলমে অবৈধ সম্পদ: প্রায় ৭৬ কোটি টাকা
-
বৈধ আয়ের উৎস: প্রায় ৭১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা
-
অসঙ্গতিপূর্ণ ও অবৈধ সম্পদ: প্রায় ৭৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা
দুদক জানায়, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন।
স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তালিকা
মিঠুর নামে রাজধানী ও ঢাকার বাইরের বিপুল সম্পদ রয়েছে।
-
ঢাকায়:
-
বনানী ডিওএইচএসে ৫ কাঠার জমিতে ৫তলা বাড়ি
-
বনানীতে ১,৮২৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট
-
উত্তরায় দুটি বাড়ি ও কয়েকটি প্লট
-
গুলশানে সুবাস্তু নজর ভিলায় দুটি ফ্ল্যাট ও কার পার্কিং
-
কল্যাণপুরে ফ্ল্যাট, টঙ্গীতে জমি ও ভবন
-
-
ঢাকার বাইরে:
-
গাজীপুর ও রংপুর জেলায় ডজনখানেক প্লট ও শত শত শতাংশ জমি
-
রংপুরের বুড়িহাট রোডে কোটি টাকায় তৈরি বাড়ি
-
-
প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগ:
-
লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ (মূল প্রতিষ্ঠান)
-
আরও ৬০টির বেশি প্রতিষ্ঠান
-
জিএমজি এয়ারলাইন্স, নর্থ চিকস প্রাইভেট লিমিটেড
-
ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল
-
কফিল উদ্দিন মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
-
শেয়ার বাজারে শত কোটি টাকার বিনিয়োগ
-
এ ছাড়া তার কাছে রয়েছে বিলাসবহুল গাড়ি, সাউথইস্টসহ বিভিন্ন ব্যাংকে শত কোটি টাকার আমানত।
মামলা ও গ্রেপ্তার
-
২০১৬ সালে পানামা পেপারসে মিঠুর নাম আসে।
-
২০২০ সালে দুদক তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে।
-
একই বছরের ৬ আগস্ট মাস্ক-পিপিই ক্রয় দুর্নীতি মামলায় তলব করা হলেও তিনি হাজির হননি।
-
২০২৩ সালে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় এবং আদালতের নির্দেশে ৭৩ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক করা হয়।
-
সর্বশেষ ২০২৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে রাজধানীর গুলশান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু গত দুই দশক ধরে স্বাস্থ্য খাতের বড় ঠিকাদারি চক্রের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। সরকারি অর্থ লুটপাট, অতি উচ্চমূল্যে নিম্নমানের বা অপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ, যন্ত্র না দিয়েই বিল উত্তোলন, বিদেশে অর্থ পাচার—সব মিলিয়ে তিনি স্বাস্থ্য খাতকে “লুটপাটের দানবে” পরিণত করেছেন। অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় গ্রেপ্তার হলেও, তার প্রকৃত সম্পদের আকার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।