ঢাকা,  বৃহস্পতিবার
২২ মে ২০২৫

Advertisement
Advertisement

ঢাকায় এখনো কুয়ার পানিতে নির্ভরশীল কয়েকটি পরিবার, পানি ওয়াসার চেয়েও ভালো

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ১৯ মে ২০২৫

ঢাকায় এখনো কুয়ার পানিতে নির্ভরশীল কয়েকটি পরিবার, পানি ওয়াসার চেয়েও ভালো

কুয়া

ঢাকার পুরান অংশে, নারিন্দার শরৎ গুপ্ত রোডের শেষ মাথায় অবস্থিত ৪৪ নম্বর বাড়িটির আঙিনায় আজও টিকে আছে একটি ইঁদারা। তবে এটি শুধু একটি পানির উৎস নয়—এই কূপটি ধরে রেখেছে শতবর্ষী ইতিহাস, একটি যুগ, এক প্রজন্ম, আর হারাতে বসা এক জলজ ঐতিহ্যের স্মৃতি।

এই কুয়াটি পাতকুয়া নয়—এটি ‘ইঁদারা’। পাতকুয়া সাধারণত মাটির পাট বসিয়ে তৈরি হয়, আর ইঁদারা সম্পূর্ণ ইট ও চুন-সুরকির গাঁথুনিতে নির্মিত হয়, যার ওপর থাকে কপিকল ঘুরিয়ে পানি তোলার ব্যবস্থা। এই পার্থক্যই বোঝায় ইঁদারার গুরুত্ব ও রাজকীয়তা। একসময় জমিদারবাড়ি ও ধনীদের বাড়িতে কেবল ইঁদারার দেখা মিলত, যেমনটি এই বাড়িতে দেখা যায়।

বাড়ির ইতিহাসও তেমনই সমৃদ্ধ। শক্তি ঔষধালয়ের প্রবর্তক অধ্যক্ষ মথুরামোহন চক্রবর্ত্তী এই ভবন প্রতিষ্ঠা করেন ১৯০১ সালে। একই বছর গড়ে ওঠে ভারতের উপমহাদেশের প্রথম আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান—‘শক্তি ঔষধালয়’। সেই প্রতিষ্ঠানেরই স্মৃতিচিহ্ন এই বাড়ি, যার দরজার ওপরে এখনো ঝুলছে জীর্ণ নহবতখানা, আর দেয়ালে লালমোহন চক্রবর্ত্তীর নাম—যিনি মথুরামোহনের ভাইপো ও উত্তরসূরি।

শক্তি ঔষধালয়ের ইতিহাস কেবল ওষুধ তৈরির ইতিহাস নয়, এটি এক স্বপ্ন, এক সাধনার গল্প। ম্যালেরিয়া যখন গ্রামগঞ্জে মৃত্যুর অন্য নাম, কুইনাইন যখন কার্যকারিতা হারাচ্ছিল, তখনই জন্ম নেয় ‘অমৃতারিষ্ট’। ব্রহ্মচারী লোকনাথের আশীর্বাদে মথুরামোহন নিজের রোগমুক্তির পর পথ পাল্টে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ঝুঁকলেন। তৈরি করেন ৩০৫টি ভেষজ ওষুধ, যার একটি বড় অংশ আজও তৈরি হয়। এখন যদিও আধুনিক যন্ত্র ও ড্রায়ার ব্যবহার হয়, তবু ফর্মুলা সেই পুরনোই।

ফিরে আসা যাক ইঁদারায়। বাড়ির পেছনে, একটি কোমর সমান উঁচু, প্রায় ১০ ফুট চওড়া মুখওয়ালা এই ইঁদারায় এখনো তোলা হয় পানি। আশেপাশের চারটি পরিবার রান্না ও গোসলের জন্য পুরোপুরি নির্ভর করে এই পানির ওপর। কেউ কেউ এটিকে ব্যবহার করেন শিশুর স্নানের জন্য, কেউ কেউ বলেন, এ পানির ঠান্ডা ছোঁয়ায় মনের ক্লান্তিও ধুয়ে যায়।

তবে এই ইঁদারায় আর পানি খাওয়ার উপযুক্ত নয়—তাই খাওয়ার পানি আনতে হয় দয়াগঞ্জের ওয়াসার এটিএম থেকে। যদিও বাড়িতে ওয়াসার সংযোগ রয়েছে, সেই পানিতে দুর্গন্ধ ও ময়লা থাকায় অনেকেই তা ব্যবহার করেন না।

নব্বই বছরের বৃদ্ধ রবিচরণ দাস এই বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো বাসিন্দা। একসময়কার জল টলটলে ছিল, ডালিমের রসের মতো। এখনো তিনি কাজ করেন ঔষধালয়ের কারখানায়—যেখানে আজও কখনো কখনো ভেষজ গাছের ঘ্রাণে ভরে ওঠে আঙিনা।

প্রিয়াংকা ঘোষ, যিনি গাজীপুর থেকে বিয়ে হয়ে এসেছেন এই বাড়িতে, জানান, এখানে এসে প্রথম দেখেছেন ইঁদারা—প্রথমে অবাক লাগলেও এখন এর সাথেই গড়ে উঠেছে আত্মিক সম্পর্ক। তার মেয়েও এখানে সাঁতার কাটে, খেলে। যেন কুয়াটিই তাদের ছোট্ট জগতের কেন্দ্র।

একটা সময়, সন্ধ্যায় এই বাড়ির দরজায় কেরোসিন বাতি জ্বলত, কলাবাগানে বাজত কিচিরমিচির পাখির কলরব। সেই রঙ হারিয়ে গেলেও টিকে আছে ইতিহাসের সাক্ষ্য—এই ইঁদারা। আধুনিক শহরের বুকে, বোতলজলের ভিড়ে আজও সে বলে যায় পুরোনো দিনের কথা। দেখা যাক, ইতিহাসের এই জলধারা আর কত দিন ধরে রাখতে পারে নিজের অস্তিত্ব…


সংক্ষিপ্ত হাইলাইটস:

  • ঢাকার নারিন্দার শতবর্ষী ইঁদারা এখনও সচল

  • শক্তি ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মথুরামোহন চক্রবর্ত্তীর বাড়ির অংশ

  • ইটের তৈরি পূর্ণাঙ্গ ইঁদারা, আজও রান্না-গোসলের কাজে ব্যবহৃত

  • খাওয়ার পানি আসে ওয়াসার এটিএম থেকে

  • ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মিশেলে ইঁদারাটি হয়ে উঠেছে জীবন্ত স্মৃতিসৌধ

প্রয়োজনে চাইলে এটিকে সংবাদ বা ফিচার আকারে আরও ঘষেমেজে ঢেলে দিতে পারি।

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531