
মাখোঁ ও ব্রিজিত
এমানুয়েল মাখোঁ ও ব্রিজিত ত্রোনিওর প্রেমকাহিনি শুধুমাত্র বয়সের ব্যবধান বা শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের গণ্ডিতে আটকে থাকা কোনো আলোচিত বিষয় নয়, বরং এটি ফ্রান্সের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নজিরবিহীন অধ্যবসায়ের গল্প—যেখানে ভালোবাসা যেমন সমাজের কটাক্ষ সহ্য করেছে, তেমনি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
ফরাসি সাংবাদিক সিলভি বোমেলের লেখা নতুন জীবনী "Il venait d’avoir dix-sept ans" (তাঁর বয়স তখন সবে সতেরো) বইটিতে এই সম্পর্কের জটিলতা, সামাজিক প্রতিরোধ, আইনি সম্ভাবনা এবং ব্যক্তিগত সংকল্পের এক বিস্তৃত বিবরণ উঠে এসেছে। বোমেলের ভাষায়, “তাঁরা একে অপরকে ১০ বছরের বেশি সময় ভালোবেসেছেন, এমনকি যখন একসঙ্গে থাকতেন না।” মাখোঁর অটল সংকল্প ও ব্রিজিতের সমাজভাঙা সাহসিকতা—এই দুটি উপাদান গড়ে তুলেছে এমন একটি দাম্পত্য, যা আজো টিকে আছে সমস্ত কেলেঙ্কারির ঊর্ধ্বে।
এমন সময় যখন ফ্রান্সের বহু প্রেসিডেন্ট ব্যক্তিগত জীবনের নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন, তখন ৪৭ বছর বয়সী মাখোঁর জীবন এই দিক থেকে ব্যতিক্রম। তিনি যেমন নিজের কাজের প্রতি সর্বান্তঃকরণে নিবেদিত, তেমনি তাঁর পারিবারিক জীবনও বেশ স্থির ও দৃঢ়। আর ব্রিজিত, যিনি ২৪ বছরের বড়, একসময় তাঁর শিক্ষক ছিলেন, পরে হলেন জীবনসঙ্গিনী—তাঁর জন্য মাখোঁর এ একনিষ্ঠতা অনেককেই বিস্মিত করেছে।
এই সম্পর্ক যে সহজ ছিল না, তা স্পষ্ট করে বলেছে বইটি। সমাজের চোখরাঙানি, ব্রিজিতের পূর্বের সংসার, স্থানীয় সমাজের গুঞ্জন এবং এমনকি মাখোঁর নিজের মা–বাবার বিরোধিতা—সব বাধা একে একে পেরিয়েছেন তাঁরা। ২০০৭ সালে তাঁদের বিয়ে হয়, দীর্ঘ অপেক্ষা ও সংঘর্ষের পরে। সমাজ যখন নিন্দা করছিল, তখন মাখোঁ ছিলেন অবিচল। এমনকি তাঁর মা–বাবা যখন ব্রিজিতকে ছেলেকে ছেড়ে দিতে বলেন, তখনো তিনি সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।
ব্রিজিত নিজেও কম সাহস দেখাননি। বিবাহিত, তিন সন্তানের মা হয়েও তিনি একটি সামাজিক ট্যাবু ভেঙেছেন—নিজের চেয়ে অনেক ছোট একজন ছাত্রের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন এবং শেষমেশ বিয়েও করেছেন। এ কারণে তাঁকে নানা সময় সামাজিক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। এলিসি প্রাসাদে পাঠানো চিঠি কিংবা সংবাদপত্রের মন্তব্য—সবখানেই ঘৃণা ও অপমানের ছায়া পড়েছে তাঁর জীবনে।
অপরদিকে, এ সম্পর্ককে ঘিরে গুজবও কম ছিল না। মাখোঁকে নিয়ে সমকামীতা, যৌন উদাসীনতা ইত্যাদি নানা গুজব ছড়ায় ২০১৪ সালের পর থেকে, যখন তিনি অর্থমন্ত্রী হন। বোমেল এই গুজবগুলোর কোনো ভিত্তি পাননি। বরং তিনি বলেছেন, গত ৫০ বছরে এই প্রথম ফ্রান্স এমন একজন প্রেসিডেন্ট পেয়েছে, যিনি একটি সুখী ও স্থিতিশীল দাম্পত্যে আছেন—এমনকি তা যতই অস্বাভাবিক বা বিতর্কিত মনে হোক না কেন।
এই দাম্পত্য সম্পর্ক মাখোঁর রাজনৈতিক সাফল্যে কী ভূমিকা রেখেছে তা সরাসরি বলা কঠিন। তবে এটা নিশ্চিত যে, তাঁর ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা, সংকল্প ও আত্মনিয়ন্ত্রণ—যেগুলো এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে—তাঁর নেতৃত্বের ধরনেও তা প্রতিফলিত হয়। ‘ইয়েলো ভেস্ট’ আন্দোলন, চরম ডানপন্থার উত্থান, জনপ্রিয়তা হ্রাস—এসবের মাঝেও মাখোঁ নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছেন।
সবশেষে বলা যায়, মাখোঁ ও ব্রিজিতের প্রেমকাহিনি একমাত্রিক কোনো কাব্যিক প্রেম নয়। এটি এক জটিল, সংঘাতপূর্ণ কিন্তু গভীরভাবে মানবিক সম্পর্কের কাহিনি—যেখানে ভালোবাসা এবং প্রতিজ্ঞা মিলেই গড়ে তুলেছে এক ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক দম্পতির জীবন। সামাজিক রীতি ভাঙলেও, ব্যক্তিত্বে ও মূল্যবোধে তাঁরা এক নতুন আদর্শের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।