
ড্যানিয়েলা ওয়েইস
১. পরিচয় ও পারিবারিক পটভূমি
ড্যানিয়েলা ওয়েইস (Daniella Weiss) জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালে, ইসরায়েলের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ের ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনে। তিনি বেড়ে উঠেছেন একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় পরিবারে। তার বাবা-মা ছিলেন লেহি (Lehi) নামক একটি ইহুদি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য—যা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সহিংস বিদ্রোহ পরিচালনা করত এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চরম অবস্থান নিত।
পরিবারটি পরে ডানপন্থী লিকুদ পার্টির সক্রিয় সদস্যে পরিণত হয়।
২. জায়নবাদী চেতনার বিকাশ ও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধকে তিনি একটি ঐশী সুযোগ হিসেবে দেখেন। এই যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা, গোলান মালভূমি ও সিনাই উপদ্বীপ দখল করে। ড্যানিয়েলার মতে, এই দখল ছিল "ঈশ্বরপ্রদত্ত জমি পুনরুদ্ধার", এবং এখানেই তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও আদর্শিক রূপরেখা নির্ধারিত হয়।
৩. রাজনৈতিক ও আন্দোলনমুখী ভূমিকা
■ গুশ এমুনিম (Gush Emunim)
১৯৭০-এর দশকে ড্যানিয়েলা গুশ এমুনিম-এর একজন মূল সংগঠক হন। এটি একটি ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, যার লক্ষ্য ছিল পশ্চিম তীর ও গাজায় ইহুদি বসতি স্থাপন। তাদের বিশ্বাস—এই জমিগুলো ঈশ্বর ইহুদিদের দিয়েছেন, কাজেই সেগুলোতে বসতি গড়া শুধু অধিকার নয়, ধর্মীয় কর্তব্য।
■ বসতি স্থাপন কার্যক্রম
ড্যানিয়েলা দাবি করেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে ১৪১টি সরকারি অনুমোদিত ইহুদি বসতি ও ২২৪টি অবৈধ চৌকির প্রতিষ্ঠায় যুক্ত ছিলেন। তিনি শুধু মতাদর্শ ছড়াননি, বরং ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইহুদি যুবকদের নিয়ে গিয়ে ঘর নির্মাণ, জবরদখল, নিরাপত্তা চৌকি গড়া ইত্যাদি সরাসরি তদারকি করেছেন।
■ নাখালা আন্দোলন (Nachala Movement)
তিনি ‘নাখালা সেটেলমেন্ট মুভমেন্ট’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এই সংগঠনের লক্ষ্য—ফিলিস্তিনি ভূমিতে নতুন বসতি গঠন এবং জমি দখলের মাধ্যমে স্থায়ী ইসরায়েলি উপস্থিতি নিশ্চিত করা। এরা ‘ফ্যাক্টস অন দ্য গ্রাউন্ড’ কৌশলে বিশ্বাস করে—অর্থাৎ, জায়গা দখল করে সেখানে বসতি গড়ে বাস্তবতা তৈরি করতে হবে যাতে সেটি অপরিবর্তনীয় হয়ে যায়।
৪. সহিংসতা ও অপরাধে সংশ্লিষ্টতা
■ বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা
জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে বসতি স্থাপনকারীরা ১,৮০০টিরও বেশি সহিংস হামলা চালিয়েছে, যার ফলে বহু ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ড্যানিয়েলা এই হামলাগুলো সরাসরি পরিচালনা না করলেও এসব গোষ্ঠীর আদর্শিক অনুপ্রেরণার উৎস এবং রাজনৈতিক অভিভাবক হিসেবে বিবেচিত।
■ আইনি ব্যবস্থা ও গ্রেপ্তার
তাঁকে কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে:
-
২০০৮ সালে, পুলিশ কর্মকর্তার ওপর হামলা ও দাঙ্গার জন্য।
-
২০১২ সালে, একটি অননুমোদিত বিক্ষোভ সংগঠনের দায়ে।
তবে প্রত্যেকবারই তাঁকে সামান্য শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
৫. গাজার পুনঃউপনিবেশ পরিকল্পনা
ড্যানিয়েলা সম্প্রতি গাজার পুনঃদখল ও উপনিবেশের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনায় এসেছেন। তাঁর মতে:
-
“গাজার আরবরা চলে যাবে”, এবং
-
“ইহুদিরা ফিরে এসে সেখানে নতুন ইসরায়েলি শহর গড়বে”।
তিনি ইসরায়েলি মন্ত্রী ও কট্টরপন্থী নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন এবং গাজার বিভিন্ন সম্ভাব্য বসতি এলাকায় সফর করেছেন। ইতিমধ্যে তাঁর পরিকল্পনায় ইসরায়েলি রাজনীতির চরম ডানপন্থী অংশের সমর্থন পেয়েছেন।
৬. আদর্শিক অবস্থান: বাইবেল ও ভূমির মালিকানা
ড্যানিয়েলার বিশ্বাস অনুযায়ী:
“ইসরায়েলি ভূখণ্ডের সীমানা নির্ধারণ করেছে বাইবেল: ফোরাত নদী থেকে নীল নদ পর্যন্ত।”
তিনি ধর্মকে ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতিকরণকে বৈধতা দেন এবং মানবাধিকারকে "সাময়িক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ" হিসেবে অবজ্ঞা করেন।
৭. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা
■ যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা
বিবিসি’র প্রামাণ্যচিত্র “The Settlers”-এ তাঁকে “উগ্র বসতি নেত্রী” আখ্যা দেওয়া হয়। এরপর যুক্তরাজ্য তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, অর্থাৎ তিনি ব্রিটেনে ভ্রমণ করতে পারবেন না বা কোনো ধরনের সম্পত্তি রাখতে পারবেন না।
■ ইসরায়েলের অভ্যন্তরে সমালোচনা
তিনি নিজ দলের মধ্যেও বিতর্কিত—তাঁর কৌশল অনেকের মতে “অত্যন্ত উস্কানিমূলক” এবং আন্তর্জাতিক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তবে ডানপন্থী সরকার ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর মধ্যে তাঁর প্রভাব অপরিসীম।
উপসংহার
ড্যানিয়েলা ওয়েইস ইসরায়েলি চরমপন্থী রাজনীতির প্রতীক, যিনি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে ও বাইরে থেকে ফিলিস্তিনি ভূমি দখলের দীর্ঘ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর কর্মকাণ্ড শুধু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটকেই উসকে দেয়নি, বরং আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার ও মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার সামনে বড় প্রশ্নও তুলেছে।