ঢাকা,  রোববার
০১ জুন ২০২৫

Advertisement
Advertisement

বিদেশি সরীসৃপের অনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য: বাস্তুতন্ত্রে হুমকি, তদারকিতে গলদ

প্রকাশিত: ১৫:২৯, ১৪ মে ২০২৫

বিদেশি সরীসৃপের অনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য: বাস্তুতন্ত্রে হুমকি, তদারকিতে গলদ

সরীসৃপ

শখ করে বিদেশি নানা প্রজাতির সরীসৃপ পুষছেন অনেকেই। সেই শখই এখন পরিণত হয়েছে এক বিশাল অনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যে, যা সরাসরি হুমকি সৃষ্টি করছে দেশের বাস্তুতন্ত্রের ওপর। নীতিমালা ও তদারকির অভাবে তৈরি হয়েছে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি—সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক এক অবৈধ প্রাণী বাজার।

ফেসবুকেই গড়ে উঠেছে প্রাণীর অবৈধ বাজার

প্রথম আলো অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফেসবুকে পেজ খুলে চলছে বিদেশি প্রাণীর অবাধ বেচাকেনা। এক্সোটিক অ্যানিমেল অব বাংলাদেশ, এক্সোটিক পেট বিডি, এক্সোটিক পেট এম্পায়ার অব বাংলাদেশ, এক্সোটিক পেট সোসাইটি অব বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি পেজে স্করপিয়ন, লিজার্ড, পাইথন, সুগার গ্লাইডার, টারেন্টুলা, চ্যামেলিয়ন, হ্যামস্টারসহ নানা প্রজাতির প্রাণী বিক্রি হচ্ছে। বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।

বিক্রেতারা ক্যাপটিভ ব্রিডিং (বদ্ধ অবস্থায় প্রজনন) দাবি করলেও, প্রকৃতপক্ষে এসব প্রাণীর অনেকটাই অবৈধ পথে দেশে আসছে। বিক্রেতারা সচরাচর এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হন না।

দুই হাজার থেকে দুই লাখ টাকা দামের প্রাণী!

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব প্রাণীর দাম দুই হাজার থেকে শুরু করে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। উদাহরণস্বরূপ, গাজীপুরের এক্সোটিক ফার্ম বিডির মালিক এক সুগার গ্লাইডারের দাম চান ৩০ হাজার টাকা। লালমাটিয়ার ফারদিন নামের এক বিক্রেতা এশিয়ান স্করপিয়নের দাম বলেন ১,৮০০ টাকা। আর বাহারি বল পাইথনের দাম উঠে যায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকায়।

পোস্টে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, কানাডা ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাণীগুলোর নামেই বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এসব প্রজাতির মধ্যে অনেকেই সাইটিস (CITES)-ভুক্ত, যার অর্থ হচ্ছে এসব প্রাণীর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত।

প্রাণিবিশেষজ্ঞদের সতর্কতা: বাস্তুতন্ত্রে ঝুঁকি, স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বলেন, ‘এসব প্রাণী অসতর্কতাবশত প্রকৃতিতে অবমুক্ত হয়ে গেলে ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটতে পারে। সাকার মাছের মতো উদাহরণ আমাদের সামনে আছে।’

তিনি যোগ করেন, ‘এসব প্রাণীর মধ্যে থাকা রোগজীবাণু অন্য প্রাণী বা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কোনো কোয়ারেন্টিন ছাড়াই দেশে ঢুকছে এসব প্রাণী, ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘এই ইনভেসিভ প্রজাতিগুলো পরিবেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। বন বিভাগসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার উচিত নজরদারি বাড়ানো, বিশেষ করে বন্দরের মতো স্পর্শকাতর জায়গায়।’

তদারকিতে গলদ, সীমিত ক্ষমতা বন অধিদপ্তরের

বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের প্রধান বন সংরক্ষক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, বিদেশি প্রাণী আনতে হলে অনুমোদন নিতে হয়। সাইটিস-ভুক্ত প্রাণী হলে আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন।

তিনি বলেন, ‘আমরা খবর পেলে বিমানবন্দরে অভিযান চালাই। তবে সার্বক্ষণিক টিম না থাকায় অনেক কিছুই আমাদের নজরের বাইরে থেকে যায়।’

মধ্যম সারির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এসব প্রাণী ঢোকে মূলত নাবিক ও যাত্রীদের মাধ্যমে। সমুদ্রবন্দরগুলোতে কার্যকর কোনো তদারকি নেই। অনেক সময় মাছের আমদানির আড়ালে আসে সরীসৃপ ও সাপ। নাবিকেরা এমনকি ডিম এনে দেশে ফুটিয়ে প্রাণী বিক্রি করেন।

সাইটিসের নিষেধাজ্ঞার কবলে বাংলাদেশ

২০২৪ সালে অবৈধ বন্য প্রাণীর বাণিজ্য রোধে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশ সাইটিসের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে, যা এখনো বলবৎ আছে। অথচ এই চুক্তির সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ এসব প্রাণীর বাণিজ্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের দায়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

প্রশ্ন থেকে যায়

প্রশ্ন থেকেই যায়—যখন বন অধিদপ্তর সরীসৃপ আমদানির অনুমতি দেয় না, তখন এত বৈচিত্র্যময় প্রাণী কোথা থেকে, কীভাবে দেশে প্রবেশ করছে? কোথায় আইন প্রয়োগের ঘাটতি?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীতিমালার কঠোর প্রয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধি, সোশ্যাল মিডিয়া নজরদারি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। না হলে খুব শিগগিরই পরিবেশের ভারসাম্য চরম ঝুঁকিতে পড়বে।

Advertisement
Advertisement

আরো পড়ুন  


Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531