ঢাকা,  বুধবার
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

Advertisement
Advertisement

আল ফারাবি: ইসলামের স্বর্ণযুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক

প্রকাশিত: ২০:১৩, ১৪ নভেম্বর ২০২৩

আপডেট: ২০:১৩, ১৪ নভেম্বর ২০২৩

আল ফারাবি: ইসলামের স্বর্ণযুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক

আল ফারাবি

ইসলামের স্বর্ণযুগে জন্ম নেয়া বিশ্বের অন্যতম দার্শনিক ছিলেন আবু নাসের মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল ফারাবি। মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে তার ছিল ভীষণ প্রভাব। বিশেষ করে ইবনে সিনা তার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন। আল ফারাবি একজন বিখ্যাত ভাষাবিদ ছিলেন। যিনি গ্রীক আর ল্যাটিন থেকে অনেক কিছুই অনুবাদ করে মুসলমানদের জন্য জ্ঞানচর্চার পথ সুগম করেছিলেন। অন্যদিকে আলকেমি, যুক্তিশাস্ত্র, দর্শন, পদার্থবিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানে ছিল আল ফারাবির বিশেষ অবদান।

আবু নাসের আল ফারাবি ৮৭০ বা ৮৭২ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের খোরাসানের ফারাব শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজের কোনো আত্মজীবনী লিখে যাননি এবং কোনো ইতিহাসবিদও তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সংরক্ষণ করেননি। এ জন্য তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না।

তবে বেশিরভাগ গবেষক ও বিশ্লেষকের মতে ফারাবি ছিলেন ইরানি বাবা-মায়ের সন্তান। ফারাবির বাবা ইরানের একজন সেনা ছিলেন। প্রখ্যাত আরব ঐতিহাসিক ইবনে আবি উজাইবাহ তার ‘ইনসানুল উয়ুন' বা ‘মানব-চোখ বা মানব-দৃষ্টি' শীর্ষক বইয়ে ফারাবিকে ইরানি বংশধারার ব্যক্তি বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। ইবনে নাদিম তার 'আলফিহরিস্ত' শীর্ষক বইয়ে এবং মনীষী আশশাহরুজিও ফারাবিকে ইরানি বলে উল্লেখ করেছেন।

মেটাফিজিক্সের জগতে আল ফারাবিকে ইসলামিক ‘নিওপ্লেটোনিজম এর জনক বলা হয়। প্লেটোনিজম বা প্লেটোর দর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ আল ফারাবি অন্ধভাবে প্লেটোর অনুকরণ করেননি। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল মদিনা আল ফাদিলা এর প্রমাণ। এই বইয়ে আল ফারাবি একদিকে যেমন প্লেটোনিক দর্শন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন,  অন্যদিকে এটিও প্রমাণ করেন যে তিনি গোঁড়া প্লেটোনিক নন। বরং তার দর্শন প্লেটোনিক দর্শনেরই একটি আমূল বদলে যাওয়া রূপ, যাকে বলা হচ্ছে নিওপ্লেটোনিজম।

আরও পড়ুন: মৃত্যুর সাতশ বছর পরেও মহাবিশ্বে প্রভাব ফেলে তার সৃষ্টিকর্ম

মধ্যযুগের সব দার্শনিক, মুসলিম বা খ্রিস্টান, সবাই নিজ ধর্ম দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। সহজ করে বলতে গেলে তাদের নিকট দর্শন মানেই ছিল ধর্মীয় দর্শন। কিন্তু আল ফারাবি এই ধারণা থেকে সরে আসেন। তিনি ধর্ম আর দর্শনের মাঝে তফাৎ বিষদভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত করেছেন জ্ঞান-বুদ্ধিতে উৎকর্ষ সাধনের জন্যই। সে সময় মুসলিম দার্শনিকরা রাজনীতিতে অনীহা ছিলেন। কিন্তু ফারাবি ছিলেন তাদের থেকে আলাদা। তিনি বেশ রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন এবং রাজনৈতিক দর্শন নিয়েও কাজ করেছেন। মুসলিম সমাজের প্রথম দিকে মনিষীদের মধ্যে আল ফারাবি একজন, যিনি জ্ঞানার্জনের জন্য খ্রিস্টান মিশনারি কিংবা ভারতবর্ষের আর্য বা হিন্দুদের সাথে অনেক সময় কাটিয়েছেন।

কৈশোর এবং যৌবনে ফারাবি কোথায় ছিলেন এবং কার কাছে জ্ঞান অর্জন করেছেন তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। কিন্তু, তার পিতা ও দাদা ছিলেন সামানিয়ান শাসনামলের উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা এবং নিঃসন্দেহে তারাই ফারাবির জ্ঞানশিক্ষা অর্জনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ফারাবি মার্ভ শহরের শিক্ষক হাজেকির কাছে বিজ্ঞান ও দর্শন শাস্ত্রের ওপর প্রাথমিক লেখাপড়া সম্পন্ন করেন। কারণ সে সময় মার্ভ ছিল ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রের  পাঠ ও আলোচনার কেন্দ্র।

শিক্ষা শেষে ফারাবি প্রথমে বিচারক হিসেবে কাজ করেন এরপর তিনি বাগদাদে যান। হিজরি ২৯৫ থেকে ৩২০ সাল পর্যন্ত তিনি বাগদাদে ছিলেন, তখন বাগদাদ ছিল ইসলামি খেলাফতের কেন্দ্র এবং মুসলিম পণ্ডিত ও চিন্তাবিদদের সমাবেশস্থল। বাগদাদে ফারাবি আরবি ভাষা, ইসলামি আইনশাস্ত্র ও  ইসলামি দর্শন ভালোভাবে রপ্ত করেন। এ ছাড়া তিনি তখনকার প্রচলিত যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্র শেখার জন্য ইয়োহান ইবনে হাইলানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন যিনি ছিলেন একজন খ্রিস্টান এবং তখনকার যুগের অন্যতম বিশিষ্ট দার্শনিকদের একজন।

আল ফারাবির লেখার প্রধান দিক ছিল নিওপ্লেটোনিজম এবং লেখার স্টাইল ছিল অ্যারিস্টটলীয়। তিনি নিজ দর্শন প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অসংখ্য দার্শনিক এবং তাদের দর্শনের কথা আলোচনা করেছেন। অন্যদিকে তার লেখা রাজনৈতিক ট্রিটিগুলো মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইহুদি দার্শনিক ম্যামোনাইডসকেও প্রভাবিত করেছিল। তিনি আল ফারাবিকে মুসলিমদের মধ্যে প্রথম যুক্তিবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। ফারাবির কাজ এবং দর্শন মুসলিমদেরকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তাকে দর্শনের ‘সেকেন্ড মাস্টার বা ‘দ্বিতীয় শিক্ষক খেতাব দেয়া হয়। তখন দর্শনের প্রথম শিক্ষক বলা হতো অ্যারিস্টটলকে আর তার পরেই দেয়া হয় আল ফারাবির স্থান।

কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আল ফারাবি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তার সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক চিন্তাভাবনা গড়ে উঠেছিল অ্যারিস্টটলিয়ান মেটাফিজিক্স, গ্রীক দার্শনিক প্লোটিনিয়াসের সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক দর্শন এবং টলেমির জোতির্বিজ্ঞানের উপর।  তার মহাবিশ্বের মডেল হচ্ছে কতগুলো সমকেন্দ্রিক বৃত্তের সমাহার। একেবারে বাইরের বৃত্তে বা চক্রে রয়েছে স্থায়ী তারকাসমূহ, শনি, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্প্রতি, বুধ এবং সবশেষে চাঁদ। আর এগুলোর একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে পার্থিব জগত। প্রতিটি চক্র একেকটি স্বর্গীয় বা অপার্থিব বস্তুর ডোমেইনের প্রতিনিধিত্ব করে। আর এগুলোই পার্থিব জগতের সাথে সৃষ্টিকর্তার যোগাযোগ স্থাপন করে। এই তত্ত্ব এক অর্থে টলেমির ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বেরই পরিবর্তিত রূপ।

আল ফারাবির রাজনৈতিক দর্শনের মূলে রয়েছে সামষ্টিক সুখ। তার মতে রাজনৈতিক নেতাকে হতে হবে সবার চেয়ে উৎকৃষ্ট চরিত্রের এবং তার প্রতিটি কাজের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য একটাই হবে আর তা হচ্ছে জনগণের সুখ। তিনি সমাজকে তিন প্রকারে চিহ্নিত করেছেন। একটি আদর্শ সমাজকে কল্পনা করেছেন ‘ভার্চুয়াস সিটি বা পুণ্যের শহর হিসেবে। এই পুণ্য নগরের তুলনা করা চলে একটি স্বাস্থ্যবান মানবদেহের সাথে। বিপরীতক্রমে আল ফারাবি আবার চার রকম খারাপ শহরের বর্ণনা করেছেন- ‘করাপ্ট সিটি বা দুর্নীতিগ্রস্ত শহর, ‘ডিসল্যুট সিটি বা চরিত্রহীন শহর, ‘টার্নকোট সিটি বা স্বমতত্যাগী শহর এবং ‘স্ট্র্যায়িং সিটি বা বিপথগামী শহর। তিনি বিভিন্ন শহরের উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন যে এরূপ শহর কোনোটিই শেষতক টিকে থাকতে পারেনি।

আল ফারাবির ভার্চুয়াস বা পুণ্য নগরীর প্রধান উৎস হচ্ছে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে একটি সুখী সমাজ গড়ে তোলার ধারণা। তার মতে সহযোগিতাই শান্তি। তিনি সমগ্র পৃথিবীকে পুণ্যময় করার স্বপ্ন দেখতেন। আর তার এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন কেবল তখনই সম্ভব হবে, যখন বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের সাথে একটি সহযোগী সম্পর্ক গড়ে তুলবে। তিনি প্রাচীন গ্রীসের দৃষ্টান্তগুলো অনুসরণ করে বলেন যে, সে রাষ্ট্রেই সর্বোচ্চ শান্তি বিরাজমান, যে রাষ্ট্রের রয়েছে একতা। আবার মানুষ হচ্ছে বিশ্বজগতে সকল সৃষ্টির মধ্যে অনন্য। কারণ তারা পার্থিব আর অপার্থিব উভয় জগতের অস্তিত্ব বুঝতে পারে। মানুষের দেহ একটি জড় কাঠামোই শুধু নয়, এর আছে অদেখা আর অদৃশ্য জগত অনুভব করার ক্ষমতা।

আল ফারাবির মতে দর্শনের দুটি দিক রয়েছে, তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক। যে সকল দার্শনিক নিজের পাণ্ডিত্য বাস্তব জীবনে সাধনা করতে পারেন না, ফারাবি তাদেরকে ভণ্ড বলে আখ্যায়িত করেছেন। সমাজকে প্রকৃত শান্তির দিকে ধাবিত করতে দার্শনিকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন তিনি। দার্শনিকরাই পারেন সাধারণ মানুষ, যাদের জ্ঞানের গভীরে প্রবেশের সুযোগ হয়নি, তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে। তার মতে দার্শনিক হচ্ছেন সমাজের চিকিৎসক। একজন চিকিৎসকের যেমন মানবদেহ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকে, একজন দার্শনিকেরও তার সমাজ সম্পর্কে বিস্তর জানাশোনা থাকা চাই। তবেই তিনি সমাজের ‘চিকিৎসা করতে পারবেন।

ফারাবি তার জীবনে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং সে অনুযায়ী বহু অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেন। তার মিশর ও সিরিয়া ভ্রমণের ব্যাপারে ইতিহাসবিদগণ নিশ্চিত। মিশর ভ্রমণ শেষে ফারাবি খোরাসান ফিরে না গিয়ে দামেস্কে চলে যান। তার জীবনের শেষ সময়গুলো দামেস্কেই কাটে এবং এখানেই ৯৫০ কিংবা ৯৫১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

সম্পর্কিত বিষয়:

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /mnt/volume_sgp1_05/p1kq0rsou/public_html/details.php on line 531