গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েল সব দিক থেকে অবরুদ্ধ করে রেখে গাজা। আর সেই সাথে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে অনবরত চলছে ইসরায়েলের বোমা হামলা। এর মধ্যে গতকাল শনিবার দুটো ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। রাফাহ সীমান্ত দিয়ে ত্রাণবাহী গাড়ির প্রবেশ ও দুই জিম্মিকে হামাসের মুক্তি।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তাতে ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার উদ্যোগে আবারও নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক হতে যাচ্ছে। কিন্তু এবারও যে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেবে, সে বিষয়ে নিশ্চত।
এ বিষয়ে আল জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখে হামলা বহু পুরোনো সামরিক কৌশল। প্রতিপক্ষের সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করে তাদের কাছে রসদ পৌঁছানোর সব রাস্তাও অবরুদ্ধ করে রাখা। ইসরায়েল আশা করে, জীবনধারণের অত্যাবশ্যক খাবার, পানি, জ্বালানিসহ অন্যান্য সেবা ও উপকরণের অভাব, রোগের প্রকোপ ও সার্বিকভাবে মনোবল হারিয়ে হতোদ্যম হয়ে তারা আত্মসমর্পণ করবে।
আরও পড়ুন: গাজায় স্থল অভিযান হলে ইসরায়েলের জন্য ভয়ানক কিছু অপেক্ষা করছে: সাবেক মার্কিন সেনাপ্রধান
এছাড়া আরেকটি মনোভাব কাজ করে। যদি প্রতিপক্ষ দ্রুত আত্মসমর্পণ নাও করে, তবুও, দীর্ঘ সময় ধরে অবরোধ ও হামলা অব্যাহত রাখলে তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ও পালটা হামলা চালানোর সক্ষমতা এক সময় ফুরিয়ে আসবে।
তবে এভাবে অবরুদ্ধ করে হামলা চালানোর বিষয়টি খুবই নির্দয় ও নির্মম। এই কৌশলের মাধ্যমে মানুষকে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, বিনা চিকিৎসায় অসুস্থ থাকা ও নানা ধরনের দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পানি না থাকায় ন্যুনতম স্বাস্থ্য-সুরক্ষাও করা যায় না। যার ফলে কলেরা, ডায়রিয়া, পানিশুন্যতার মতো নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
গাজা উপত্যকাকে ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরায়েল। এতদিন এখানকার বাসিন্দাদের জীবনধারণের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হলেও এবার ৭ অক্টোবর থেকে তাও নেই। ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের পণ্য, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। গাজায় প্রবেশের সব পথ বন্ধ থাকায় সেখানে কোনো ধরনের মানবিক সহায়তা বা ত্রাণ পৌঁছাতে পারেনি। আর সেই সঙ্গে ইসরায়েলের নির্বিচার বিমান হামলা ও উত্তর থেকে সরে দক্ষিণে চলে যাওয়ার নির্দেশে গাজার বাসিন্দারা নিরুপায় ও অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। েএর অর্থ হচ্ছে, গাজার ২০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি এখন পুরোপুরি ত্রাণ সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
১৯৯০ সালে বসনিয়া ও আফগানিস্তানেও একই ধরনের অবরোধ ও হামলার ঘটনা ঘটে। কাবুলের কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যমে আসলেও বসনিয়ায় সার্বদের হামলার বর্বরতা সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। প্রায় চার বছর সার্বরা বসনিয়ার রাজধানী অবরুদ্ধ রেখে হামলা চালায়। হত্যা করা হয় অসংখ্য মুসলমানদের। বসনিয়া হার্জেগোভিনায় পর্যাপ্ত নদ-নদী ও লেকের পানি থাকায় মানুষ তা ব্যবহার করতে পেরেছিল। কিন্তু গাজায় মিঠা পানির উৎস নেই বললেই চলে। ফলে এখানে পিপাসা মেটানোর বিকল্প কোনো উপায় নেই।
আরও পড়ুন: ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে পাল্টে যাচ্ছে মস্কো-তেল আবিব সম্পর্ক
খাদ্য ও পানির মৌলিক চাহিদাকে মাথায় রেখে বলা যায়, গাজার ফিলিস্তিনিদের দৈনিক অন্তত দুই কেজি ত্রাণ প্রয়োজন। প্রায় ২০ লাখ মানুষের জন্য তা দাঁড়ায় দৈনিক চার হাজার টন। একটি ট্রাকে মাত্র ২০ টন পণ্য ধারণ করা সম্ভব। এ ছাড়া, ত্রাণ ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছানোও বেশ কষ্টের কাজ। ইসরায়েলের শর্ত হচেছ বহির্বিশ্ব থেকে ত্রাণ অব্যাহত রাখতে একটি বন্দর ব্যবহার করতে পারবে এবং সেখানে দৈনিক দুই জাহাজ ভর্তি ত্রাণ পৌঁছাতে হবে। সৌভাগ্যবশত মিশর উপকূলে, রাফাহ থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে সিনাই শহরে এ ধরনের একটি বন্দর রয়েছে।
উড়োজাহাজে করে কিছু জরুরি সামগ্রী নিয়ে আসা সম্ভব, কিন্তু তাতে গাজার বাসিন্দাদের সব চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। গাজা উপত্যকার একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত গাজা বিমানবন্দর ২০০১ সালে ইসরায়েল ধ্বংস করে দেয়। তবে এর কাছাকাছি মিশরের দুইটি বিমানবন্দর আছে—আল-গোরাহ ও এল আরিশ।
সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে, তা হলো গাজায় নিয়মিত ত্রাণ আদৌ পৌঁছানো যাবে কী না, সে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। বর্তমানে ব্যবস্থায় মাত্র ২০ ট্রাক ত্রাণ রাফাহ সীমান্ত পার হতে পারে। যা একেবারেই অপ্রতুল।