
বায়ু দুষণ
রাজধানীর আকাশে যখন ধুলোর পর্দা, তখন ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ঘোষিত এয়ার পিউরিফায়ার বসানোর পরিকল্পনা স্বস্তির বার্তা দিতে পারে অনেকের কাছে। গুলশানে ডিএনসিসির নগর ভবনে আয়োজিত এক পলিসি ডায়ালগে প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ঘোষণা দেন, রাজধানীর অন্তত ৫০টি স্থানে বসবে এইচডিসিটি ৫১০০০ মডেলের স্থির বায়ু পরিশোধন যন্ত্র। প্রতিটি যন্ত্র নাকি ১০০টি গাছের সমান বায়ু পরিশোধন ও শীতলীকরণ করতে পারবে।
যদিও ডিএনসিসি বলেছে, এই প্রকল্পের ব্যয় বহন করবে স্পনসর প্রতিষ্ঠান, এবং এটি একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে শুরু হচ্ছে—তবুও বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধান নয়।
গবেষকদের আপত্তি: "বায়ুদূষণ দমনে নয়, সাময়িক স্বস্তির উপায়"
বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য অনেকটা একসুরে: ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে স্থানভিত্তিক এয়ার পিউরিফায়ার বসিয়ে সামগ্রিক বায়ুমান উন্নয়ন সম্ভব নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, “বড় দেশগুলোও এ ধরনের প্রকল্পে সফল হতে পারেনি। আমাদের উচিত দূষণের উৎস চিহ্নিত করে তা নিয়ন্ত্রণ করা।” তিনি হুঁশিয়ার করে বলেন, এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে হলেও একসময় রাষ্ট্রকেই এর দায় নিতে হতে পারে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান বলেন, “এয়ার পিউরিফায়ার এখনো আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মাত্র। যেখানে সবাই দূষিত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে, সেখানে কয়েকটি জায়গায় পরিশুদ্ধ বাতাসের ব্যবস্থা করা ন্যায্যতাবিরোধী।”
বাস্তবতার আয়নায় দিল্লির ব্যর্থতা
ঢাকায় যে ধরনের যন্ত্র বসানোর কথা হচ্ছে, তার অনুরূপ উদাহরণ রয়েছে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। ২০২১ সালে ২৪ মিটার উচ্চতার একটি স্মগ টাওয়ার বসানো হয় কনট প্লেসে। এটি মাত্র ৫০ মিটারের মধ্যে কিছুটা কার্যকর হলেও এর বাইরের এলাকায় কোনো বাস্তব প্রভাব ফেলতে পারেনি। এমনকি ২০২৩ সালে দিল্লি দূষণ নিয়ন্ত্রণ কমিটি ও ভারতের জাতীয় পরিবেশ আদালত একে "অবাস্তব ও অকার্যকর" বলে রায় দেয়।
ঢাকা: পৃথিবীর তৃতীয় দূষিত নগরী
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশ রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে, আর ঢাকা তৃতীয়। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) জানায়, গত ৯ বছরে ঢাকাবাসী মাত্র ৩১ দিন নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে, বাকিসব দিনই ছিল দূষিত, অস্বাস্থ্যকর কিংবা দুর্যোগপূর্ণ।
কী হতে পারে টেকসই সমাধান?
বিশেষজ্ঞরা একমত, বায়ু পরিশোধন যন্ত্র নয়, বরং উৎস নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে সমস্যার মূলে পৌঁছানোর চাবিকাঠি। তাদের প্রস্তাবিত কার্যকর উদ্যোগগুলো হলো:
-
কালো ধোঁয়া ছাড়ানো পুরোনো যানবাহন নিয়ন্ত্রণ
-
নির্মাণস্থলের ধুলা নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ
-
অবৈধ ইটভাটা বন্ধ
-
শহরজুড়ে সবুজায়ন বাড়ানো
-
পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনা
-
বায়ুর গুণমান মনিটরিং স্টেশন স্থাপন করে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ
অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, “আমরা টাস্কফোর্স করি, সভা করি, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এ কারণেই বায়ুদূষণ রয়ে যায় আগের মতোই।”
ডিএনসিসির এয়ার পিউরিফায়ার বসানোর পরিকল্পনা একটি সচেতন প্রচেষ্টা হলেও এটি যেন কসমেটিক সমাধান হয়ে না থাকে। বাস্তব ও টেকসই পরিবর্তন আনতে হলে দরকার দূষণের উৎসে হস্তক্ষেপ, কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ এবং জনসম্পৃক্ত কার্যক্রম। না হলে শহরের বাতাসে থাকবে শুধু ধুলা আর অসহনীয় শ্বাসকষ্ট।