মোঘল সম্রাটদের বিষয়ে এখনো মানুষের নানা কৌতূহল। তারা কি ধার্মীক ছিলেন, নাকি হিন্দুদের সঙ্গে মিল রেখে ধর্ম পালন করতেন। আবার অনেকে মনে করেন মোঘল সম্রাটরা মদ্যপান করতেন না। তবে ইতিহাসে রাজ পরিবারে মদপানের অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়।
তবে সম্রাটদের হেরেম সম্পর্কে কৌতূহল হয়তো সবচেয়ে বেশিই। সম্রাট আকবরের আমলেই মোঘলদের হেরেমের সঠিক চেহারা পেলেও বাবরের আমল থেকেই হেরেমের অস্তিত্বের কথা জানা যায়।
আকবরের কি হেরেম ছিল? কেমন ছিল সেই অন্তঃপুরবাসিনীদের জীবন? সেখানে সবাই কি সম্রাটের ভোগ্য ছিল? রাজপুরুষদের হাতে বন্দিনী নারীদের জীবনে যৌনতার ছবিটাই বা কীরকম ছিল? কয়েকশো বছর পেরিয়ে গেলেও ইতিহাসের বুকে কান পাতলে আজও এই প্রশ্নগুলোকে ভেসে বেড়াতে শোনা যায়।
হেরেম শব্দটা এসেছে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার সম্মিলিত অঞ্চল যাকে ‘নিয়ার ইস্ট’ বলা হয় সেখান থেকে। অর্থ ‘গোপন পবিত্র স্থান’।
হেরেম মানেই যৌনতা ও বৈভব
মোঘল হেরেম সম্পর্কে বহু কথা, নানা জীবনী, আত্মজীবনী ও ঐতিহাসিক বিবরণ আছে। কিন্তু এর অধিকাংশই ভুয়া ও ভিত্তিহীন। বক্তব্যের সম্পর্কে নেই কোনও নিশ্চিত প্রমাণ। তবে এই তথ্যে কোনও ভুল নেই যে, এই মহিলামহলে কেবল সম্রাট ছাড়া আরও কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। সেই সঙ্গে এও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে এখানে কেবল রাজমহিষীরাই থাকতেন তা নয়। উপপত্নী ও দাসীরাও থাকতেন। অবশ্যই ‘পজিশন’ অনুযায়ী, থাকার ব্যবস্থা ছিল আলাদা রকমের। হেরেম মানেই যে অবাধ যৌনতার ছড়াছড়ি তা কিন্তু নয়।
হেরেম কী
হেরেমের কথা প্রায় সব রাজপরিবারের ভেতরেই পাওয়া যায়। হেরেমে সম্রাটদের একাধিক স্ত্রী, উপপত্নী, অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুত্র, অবিবাহিত কন্যা, আত্মীয়া এবং দাসীরা থাকতো। অর্থাৎ হারেমে সবাই যে রাজরক্তের ছিল না তা স্পষ্ট, আবার সবাই যে যৌনদাসী সেটিও নয়।
তখনকার সময়ে রাজা বাদশাহদের অনেক পত্নী আর উপপত্নী থাকবে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম ছিল। নিজেদের দাস-দাসী আর পত্নীদের সম্রাট নিজের ইচ্ছেনুযায়ী ব্যবহার করবেন সেটাও অবাক করার মতো ব্যাপার ছিল না। হেরেমে তাই সর্বাধিক গুরুত্ব পেত আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা।
অন্তঃপুরের থাকতো বাদ্যযন্ত্র এবং হাতি, ঘোড়া ও রথের সাজসজ্জা। সম্রাটের বিনোদনের জন্য হেরেমে প্রায় সব ধরনের সুযোগ সুবিধা রাখা হতো। তাই সম্রাটের আত্মীয়-পরিজনের পাশাপাশি থাকত সঙ্গীতশিল্পী আর নৃত্যশিল্পীরাও। মাঝে মাঝেই বসত নৃত্যগীতের আসর।
পৃথিবীর সকল যুদ্ধবাজ সম্রাটদের বিরুদ্ধে যেসব অপবাদ শোনা যায় তার ভেতরে উল্লেখযোগ্য হলো যুদ্ধে জয়লাভ করার পর বিভিন্ন প্রদেশ কিংবা অঞ্চল থেকে নানান ধর্ম ও বর্ণের মেয়ে এনে নিজেদের হেরেমে রাখা হতো। মুঘল হেরেমেও এর বাইরে ছিল না। এসব হেরেমে কখনো কখনো মেয়েদের সংখ্যা ৭ থেকে ৮ হাজার ছাড়িয়ে যেত। সম্রাট আকবরের হেরেমেই নাকি প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি বেগম ও সেবিকা ছিল!
হেরেম সংস্কৃতির প্রথম দিকে প্রাসাদের অভ্যন্তরেই আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তীতে নারীদের জন্য আলাদা ভবন নির্মাণ শুরু হয়। মোঘল আমলেই হেরেম পূর্ণাঙ্গ রাজকীয় পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকাশ লাভ করে। শাহী পরিবারের নারীদের আবাসস্থলগুলো ‘মহল’ নামে পরিচিত ছিল। এছাড়াও জেনানা, মহল-সারা, হারেম-সারা, হারেম-গাঁ, মহল-সারা, রানীবাস ইত্যাদি নামেও হেরেমকে আখ্যায়িত করা হতো।
সম্রাট আকবরের হেরেম কেমন ছিল
কেমন ছিল হারেমের জীবন? এখানে ঢোকা মানেই বাইরের জগতের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া। আকবরের আমলে তৈরি হওয়া হেরেমে ঐতিহ্য পরবর্তী সময়ে রক্ষা করেছিলেন জাহাঙ্গির, শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবও। তবে সম্রাট জাহাঙ্গিরের হেরেম সবথেকে বেশি আলোচনায় আসে। ওলন্দাজ ব্যবসায়ী ফ্রান্সিসকো পেলসের্ট জাহাঙ্গিরের আমলে ভারতে এসেছিলেন। তার লিখিত বিবরণ থেকে জানা যায়, মাত্র ২৫ বছর বয়সেই ২০ জন স্ত্রী ছিল জাহাঙ্গিরের। দাসী ছিল তিনশোরও বেশি।
পরে যত বয়স বেড়েছে ততই সংখ্যায় বেড়েছে তার স্ত্রী ও দাসীর সংখ্যা। শিল্পরসিক জাহাঙ্গিরের আমলে হেরেমের ভেতরে মহলগুলো যেমন ঐশ্বর্যে ঝলমল করত, তেমনি হেরেমের বন্দিনীদের পরনেও থাকত ভারী পোশাক, ঝলমলে গয়নাগাটি। তাদের শরীরে ভুরভুর করত সুগন্ধীর সুঘ্রাণ। বলা হয়, সেই বন্দিনীদের জীবনের মোক্ষই ছিল যেনতেন প্রকারণে সম্রাটকে খুশি করা। জাহাঙ্গিরই একমাত্র মোঘল সম্রাট, যিনি মদ ও আফিমে ডুবে থাকতেন। কোনও কোনও বর্ণনায় মেলে, তিনি নাকি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে মেয়েদের মাঝে গিয়ে বসতেন।
হেরেম নিয়ে একটি অসামান্য বই ‘ডটার্স অফ দ্য সান: এমপ্রেসেস, কুইনস অ্যান্ড বেগমস অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার’। এখানে লেখিকা ইরা মুখোটি লিখেছেন, বাবর ও হুমায়ুনের আমলে হেরেমের চেহারা এতটাও গোপনীয় ছিল না। কারণ সেসময় হেরেমের মহিলাদের অধিকাংশই চাগতাই তুর্কিষ এই মহিলারা কেবল ঘর সামলাতেন না। যুদ্ধনীতি থেকে রাজনীতিতেও ছিলেন চৌকস। আকবরের আমল থেকেই হেরেমকে ঘিরে গোপনীয়তার কুয়াশা গড়ে উঠে। আর সেই কুয়াশাকে ঘিরে পাক খেতে থাকে অদম্য কৌতূহল। আগেই বলেছি, যে কৌতূহল আজও একই ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। কয়েকশো বছরেও তার নিবৃত্তি হয়নি।