
হিরা
ঢাকার নবাব পরিবারের সংগ্রহে থাকা ১০৯ ধরনের রত্নালংকারের মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় এবং ঐতিহাসিক হিরাটি হলো ‘দরিয়া-ই-নূর’। ২৬ ক্যারেটের এই টেবিল কাট হিরাকে বলা হয় কোহিনূরের ‘আত্মীয়’। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ভারতের গোলকুন্ডা খনি থেকে পাওয়া এই হিরাটি মারাঠা রাজা, হায়দরাবাদের নবাব, পারস্যের সম্রাট এবং ব্রিটিশ শাসকদের হাত ঘুরে এক সময় স্থান পায় ঢাকার নবাব খাজা আলীমুল্লাহর গয়নার বাক্সে।
১৮৫২ সালে কলকাতায় হ্যামিল্টন অ্যান্ড কোম্পানি আয়োজিত এক নিলামে নবাব খাজা আলীমুল্লাহ ৭৫ হাজার টাকায় হিরাটি কিনে নেন। এরপর থেকে হিরাটি নবাব পরিবারের সংগ্রহে ছিল। ১৯০৮ সালে নবাব সলিমুল্লাহ ঋণ নেওয়ার সময় দরিয়া-ই-নূরসহ অন্যান্য রত্ন বন্ধক রাখেন। সেসময় হিরাটির মূল্য ধরা হয়েছিল ৫ লাখ রুপি।
তবে তারপর থেকেই দরিয়া-ই-নূর একটি রহস্যের আবরণে ঢাকা পড়ে যায়। সরকারি নথি অনুযায়ী, হিরাটি সোনালী ব্যাংকের ভল্টে সংরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না, হিরাটি আদৌ ভল্টে আছে কি না। ভূমি সংস্কার বোর্ডও এ বিষয়ে নিশ্চিত নয়। বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করা হলেও অনুমতির অভাবে ভল্টের প্যাকেট খোলা সম্ভব হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দরিয়া-ই-নূরের শুধু অর্থনৈতিক নয়, রয়েছে অনন্য ঐতিহাসিক গুরুত্বও। ১৮৫১ সালের দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ–এ হিরাটির ছবি ছাপা হয়, যেখানে হিরাটিকে মিনা করা সোনায় বসানো এবং চারপাশে মুক্তা দিয়ে ঘেরা অবস্থায় দেখা যায়।
নবাব পরিবারের ইতিহাস গবেষক ও আহসান মঞ্জিলের সাবেক কিউরেটর মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, হিরাটি এক সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখল করলেও পরবর্তীতে ঢাকার নবাবদের হাতে ফেরে। কিন্তু ১৯০৮ সালের পর থেকে হিরাটি আর জনসমক্ষে দেখা যায়নি।
এদিকে ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জুয়েলারি মিউজিয়ামে একটি ১৮২ ক্যারেটের গোলাপি টেবিল কাট হিরাকেও ‘দরিয়া-ই-নূর’ বলা হয়। ঢাকার হিরা ২৬ ক্যারেটের হওয়ায় গবেষকেরা ধারণা করছেন, ইরানের হিরাটি ভিন্ন হলেও উত্স একই—গোলকুন্ডা খনি।
বর্তমানে সরকার দরিয়া-ই-নূরের প্রকৃত অবস্থান ও অস্তিত্ব যাচাইয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রক্রিয়াটি এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়। কমিটি গঠনের পর হিরা থাকার প্যাকেট খুলে দেখা হবে।
ইতিহাসবিদ ও জাদুঘর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যদি হিরাটি সত্যিই বাংলাদেশে থেকে থাকে, তবে তা জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা উচিত। এতে যেমন ইতিহাস সংরক্ষিত থাকবে, তেমনি নতুন প্রজন্মও জানবে বাংলার হারানো গৌরবের গল্প।
১১৭ বছর ধরে ভল্টে আটকে থাকা দরিয়া-ই-নূর যেন আজ শুধু একটি হিরা নয়, বরং ইতিহাস, রাজনীতি ও জাতীয় পরিচয়ের এক নিঃশব্দ দলিল। সেই দলিলের জাদুঘরে জায়গা পাওয়া এখন সময়ের দাবি।