ঢাকা,  সোমবার
১৩ অক্টোবর ২০২৫

Advertisement
Advertisement

যুদ্ধবিরতি হয়েছে, কিন্তু হামাস কি অস্ত্র ছাড়বে

প্রকাশিত: ১৯:৩৫, ১০ অক্টোবর ২০২৫

যুদ্ধবিরতি হয়েছে, কিন্তু হামাস কি অস্ত্র ছাড়বে

ইসরায়েল

যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু হামাস কি অস্ত্র সমর্পণ করবে? এই প্রশ্নটিই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপের বিষয়ে ইসরায়েল হামাস রাজি হয়েছে ঠিকই, তবে দুই পক্ষের বিরোধ রয়ে গেছে এখনো। এই বিরোধের কেন্দ্রে রয়েছে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাসের কাছে থাকা অস্ত্রভান্ডার।

ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে, গাজায় দুই বছরের যুদ্ধ শেষ করতে হলে হামাসকে সব অস্ত্র জমা দিতে হবে, ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হবে এবং সংগঠন হিসেবে নিজেদের ভেঙে দিতে হবে।

অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান হামাস প্রকাশ্যেই প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংস্থাটি গোপনে কিছু অস্ত্র সমর্পণের বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে।

ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ইসরায়েল-ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিউ লোভ্যাট বলেন, ‘আপনারা দেখে থাকবেন, অস্ত্র সমর্পণের বিষয়েই হামাসের অবস্থান সবচেয়ে বেশি বদলেছে।

হিউ লোভ্যাট আলজাজিরাকে আরও বলেন, ‘হামাসের কর্মকর্তারা গোপনে মধ্যস্থতাকারীদের বলেছেন যে তাঁরা কিছু আক্রমণাত্মক অস্ত্র ছাড়ার প্রক্রিয়ায় রাজি হতে পারেন।

ইসরায়েলের দুই বছরের অভিযানে অর্ধ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনির প্রাণহানির পর গতকাল বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি হয় গাজা নিয়ন্ত্রণকারী হামাস।

আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তাবিষয়ক আইনের আওতায় যুদ্ধকালীন সাধারণ নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর অস্ত্র বহন করার এবং দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অধিকার আছে। তবু ইসরায়েল এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারির অবসানে শান্তি প্রক্রিয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে সেখানকার বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সশস্ত্র প্রতিরোধ থেকে সরে আসতে বলে থাকে।

নাজুক যুদ্ধবিরতি

বিশ্লেষকেরা বলছেন, হামাসের অস্ত্রভান্ডার নিয়ে আলোচনায় মতৈক্য না হলে ভেঙে যেতে পারে যুদ্ধবিরতি এবং তাতে গাজায় আবার ইসরায়েলের জাতিগত নিধন শুরু তৈরি হবে।

আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তাবিষয়ক আইনের আওতায় যুদ্ধকালীন সাধারণ নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর অস্ত্র বহন করার এবং দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অধিকার আছে। তবু ইসরায়েল এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারির অবসানে শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হিসেবে সেখানকার বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সশস্ত্র প্রতিরোধ থেকে সরে আসতে বলে থাকে। ১৯৯০-এর দশকে ফিলিস্তিন ইসরায়েলি নেতাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত অসলো শান্তিচুক্তির ভিত্তিও ছিল এটি।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) গবেষক আজমি কেশাওইয়ের মতে, ইসরায়েল সম্ভবত এবারও একই ধরনের দাবি করবে। তবে হামাস পুরোপুরি অস্ত্র সমর্পণ করবে বলে মনে হয় না।

তাঁর ধারণা, হামাস কেবল স্বল্প দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রসহ কিছু আক্রমণাত্মক অস্ত্র সমর্পণ করতে পারে।

হামাস কখনোই তাদের ছোট হালকা অস্ত্র ছাড়বে না বলেই মনে করেন গাজার বাসিন্দা ফিলিস্তিনের নাগরিক কেশাওই। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দশকের পর দশক ধরে যে সুড়ঙ্গগুলো তৈরি করা হয়েছে, তার জটিল নেটওয়ার্কের মানচিত্রও হস্তান্তর করবে না বলে মনে করেন তিনি।

কেশাউই আলজাজিরাকে বলেন, ‘(হামাস) শুধু তখনই অস্ত্র (হালকা) ছাড়বে, যখন এসব অস্ত্রের আর কোনো প্রয়োজন থাকবে না। এর মানে, তারা কেবল এমন একটি ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের কাছে এগুলো হস্তান্তর করবে, যারা ইসরায়েলের দখল শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেবে।

 

ইসরায়েল হামাস গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে একমত হয়েছে বলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেওয়ার পর গাজাসংলগ্ন ইসরায়েলি সীমান্তে ইসরায়েলি ট্যাংকগুলো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অক্টোবর, ২০২৫ ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েল হামাস গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে একমত হয়েছে বলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেওয়ার পর গাজাসংলগ্ন ইসরায়েলি সীমান্তে ইসরায়েলি ট্যাংকগুলো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অক্টোবর, ২০২৫ ছবি: রয়টার্স

ক্ষমতার শূন্যতা?

হামাস ২০২৩ সালের অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এর জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। তার আগপর্যন্ত গাজার সবচেয়ে বড় সশস্ত্র গোষ্ঠী ছিল হামাস। তবে দুই বছরের যুদ্ধে শীর্ষনেতাদের অধিকাংশকে হারিয়ে দলটি এখন বিপর্যস্ত।

গাজার অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে আছেপ্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে), পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (পিইএলপি) এবং আল-আকসা মার্টায়ারস ব্রিগেডস। এই গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই চালিয়ে আসছে। তবে গত দুই বছর ধরে ইসরায়েলের চালানো বিমান হামলায় তারা কতটা দুর্বল হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গাজায় হামলা চালানোর পাশাপাশি ইসরায়েল সেখানকার কিছু কুখ্যাত গ্যাংকেও সাহায্য করেছে। গ্যাংগুলো গাজায় সীমিত পরিসরে পৌঁছানো সহায়তাগুলো লুটপাট করছে।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশ্লেষক তাগরিদ খোদারি বলেছেন, গাজার অনেক ফিলিস্তিনি মনে করে হামাসের হাতে কিছু সামরিক ক্ষমতা রাখতেই হবে, যেন ক্ষমতার শূন্যতার সুযোগে এই গ্যাংগুলো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারে।

গাজার অনেক ফিলিস্তিনি মনে করে হামাসের হাতে কিছু সামরিক ক্ষমতা রাখতেই হবে, যেন এই গ্যাংগুলো ক্ষমতার শূন্যতার সুযোগে শোষণ করতে না পারে

তাগরিদ খোদারি, ইসরায়েল-ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশ্লেষক

তাগরিদ খোদারি আরও বলেন, ‘ইসরায়েল গ্যাং তৈরি করেছে এবং তাদের অস্ত্র বন্দুক দিয়েছে, যেন তারা নিজেদের (গাজার বাসিন্দা) মানুষদের হত্যা করতে পারে। এখন ইসরায়েল হামাসকে সরাতে চায়, কিন্তু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখতে হামাসকে প্রয়োজন। হামাস নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ পারদর্শী।

ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ইসরায়েল-ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিউ লোভ্যাটের মতে, হামাস একটি অন্তর্বর্তীকালীন টাস্কফোর্সকে সহযোগিতায় রাজি হতে পারে। ওই টাস্কফোর্স নিরাপত্তা দেবে এবং তাদের কিছু অস্ত্রের আংশিক সমর্পণের কার্যক্রম তদারকি করবে।

তবে হিউ লোভ্যাট মনে করেন, হামাস শুধু তখনই টাস্কফোর্সকে সহযোগিতা করবে, যখন ওই টাস্কফোর্সের ম্যান্ডেটে স্পষ্টভাবে লেখা থাকবে যে তারা কোনোভাবেইসন্ত্রাসবিরোধীভূমিকা নেবে না।

লোভ্যাট আলজাজিরাকে বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে পশ্চিমা দেশগুলো এমনসন্ত্রাসবিরোধীভূমিকা রাখতে চাইবে না। আর হামাসও তা মেনে নেবে না। এতে আন্তর্জাতিক টাস্ক ফোর্স আসলে ইসরায়েলের লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে, তাই প্রকাশ করবে।

হামাস একটি ধারণা

গাজায় জাতিগত নিধন চলাকালে ইসরায়েল দাবি করেছিল, তাদের যুদ্ধের লক্ষ্য হলো হামাসকে ধ্বংস করা। তবে আইসিজির গবেষক কেশাউই বলেন, হামাসকে কখনো পুরোপুরি পরাজিত করা যাবে না।

কেশাউইর ধারণা, আগামী কয়েক বছরে হামাস তাদের দলে হাজার হাজার দরিদ্র প্রতিশোধপ্রবণ তরুণকে যুক্ত করবে। তাঁর মতে, অনেকের কাছেই হামাস নিছক একটি সংগঠন নয়এটি একটিধারণা’, যা প্রতিরোধের প্রতীকী রূপ।

কেশাউই আলজাজিরাকে বলেন, ‘এই সংগঠনটি পুরো আরব বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা এমন এক যুদ্ধ লড়েছে, যা তারা লড়তে পারবে বলে কেউ ভাবতেও পারেনি; যদিও এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে তাদের।

লোভ্যাট আবার হামাসকে বাস্তবমুখী বলে মনে করেন। তাঁর মতে, যুদ্ধবিরতি যত দিন সম্ভব টিকিয়ে রাখতে হামাস কিছু ছাড় দিতে প্রস্তুত।

লোভ্যাট বলেন, এই যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অন্য পশ্চিমা নেতাদের ওপর নির্ভর করছে। তারা ইসরায়েলকে কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে এবং দেশটির দাবিগুলোকে কতটা সীমিত করে আনতে পারে, সে বিষয়টির ওপর তা নির্ভর করছে।

লোভ্যাটের ধারণা, খুব সম্ভবত ইসরায়েল পশ্চিমা দেশগুলোকে রাজি করিয়ে ফেলতে পারবে যে দখলদারি অবসানের আগে হামাসকে পুরোপুরি নিরস্ত্র করা দরকার।

আলজাজিরাকে লোভ্যাট বলেন, ‘যদি এমনটা ঘটে, তবে এটি পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য ইসরায়েলকে দায়মুক্ত করার নতুন অজুহাত হবে, যেমনটা অসলো চুক্তির সময় ঘটেছিল।

Advertisement
Advertisement

আরো পড়ুন  


Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531