
টিউলিপ
যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সংসদ সদস্য (এমপি) টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক আবারো আলোচনায়। নিজেকে শুধুই ব্রিটিশ নাগরিক দাবি করলেও সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, তিনি এক দশকেরও বেশি সময় বাংলাদেশে নিয়মিত করদাতা ছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর নামে ঢাকায় একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটেরও খোঁজ মিলেছে, যা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় ‘অবৈধ সুবিধা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
নাগরিকত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব
-
টিউলিপ দীর্ঘদিন ধরে দাবি করেছেন, তিনি কেবল ব্রিটিশ নাগরিক।
-
তবে পাওয়া গেছে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র (২০১১ সালে ইস্যু) ও বাংলাদেশি পাসপোর্ট (২০০১ সালে লন্ডনে ইস্যু)।
-
নির্বাচন কমিশনের রেকর্ড অনুযায়ী, তিনি এখনো বাংলাদেশের ভোটার।
-
এসব প্রমাণকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ—দুই দেশেই শুরু হয়েছে তীব্র আলোচনা।
কর নথি: নিয়মিত করদাতা টিউলিপ
প্রথম আলোর অনুসন্ধান এবং দুদকের জব্দ করা নথি অনুযায়ী—
-
২০০৫–০৬ অর্থবছর থেকে ২০১৫–১৬ পর্যন্ত টিউলিপ নিয়মিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন।
-
আয় হিসেবে তিনি সবসময় “ব্যবসা/পেশার আয়” দেখিয়েছেন।
-
২০১২–১৩ অর্থবছরে তিনি মাছের ব্যবসা থেকে ৯ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন, তবে ব্যবসার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব মেলেনি।
-
সর্বোচ্চ আয় দেখানো হয় ২০১৪–১৫ অর্থবছরে (৭.১৭ লাখ টাকা)। এর মধ্যে ব্যবসা/পেশার আয় ৫.৬৫ লাখ এবং ব্যাংক সুদ বাবদ আয় ১.৫২ লাখ। কর দেন ৪২,৬৩৭ টাকা।
-
একাধিক অর্থবছরে নগদ অর্থ, ব্যাংক জমা ও ১০ ভরি সোনার গয়নার উল্লেখ ছিল।
দুদকের দাবি: যদি তিনি কেবল ব্রিটিশ নাগরিক হতেন, তাহলে এভাবে বাংলাদেশে কর ফাইলিংয়ের প্রশ্নই উঠত না।
গুলশানের ফ্ল্যাট: ঘুষ নাকি উপহার?
-
গুলশান–৭১ নম্বর রোডে ২৪৩৬ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের মালিক টিউলিপ।
-
দুদকের তদন্তে জানা গেছে, ইস্টার্ন হাউজিং নামের প্রতিষ্ঠান এই ফ্ল্যাট তাঁকে দিয়েছে তাঁর খালা শেখ হাসিনার প্রভাব খাটানোর বিনিময়ে।
-
ফ্ল্যাটের মূল্য ছিল প্রায় ৪৫ লাখ টাকা, অথচ টিউলিপ কেবল ২ লাখ টাকা পরিশোধ করেন।
-
অভিযোগ, বিনা মূল্যে ফ্ল্যাটটি তিনি ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন।
-
২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর টিউলিপ ফ্ল্যাটটি ছোট বোন আজমিনা সিদ্দিককে হেবা (দান) করেন। তবে দুদকের দাবি, ওই হেবা নথি জাল।
-
এপ্রিল ২০২৫ সালে আদালতের নির্দেশে ফ্ল্যাটটি জব্দ করা হয়।
মামলা ও আইনি পদক্ষেপ
-
টিউলিপের বিরুদ্ধে চারটি দুর্নীতি মামলা হয়েছে।
-
এর মধ্যে তিনটির অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে, একটি তদন্তাধীন।
-
দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন জানিয়েছেন, “বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবেই টিউলিপের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। প্রমাণ হিসেবে এনআইডি, পাসপোর্ট ও কর নথি আদালতে উপস্থাপন করা হবে।”
টিউলিপের প্রতিক্রিয়া
-
টিউলিপ ও তাঁর আইনজীবীরা অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার বলে দাবি করেছেন।
-
তাঁর আইনজীবী প্রতিষ্ঠান Stephenson Harwood বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি।
-
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি মামলাকে “হয়রানি ও প্রহসন” বলে আখ্যা দিয়েছেন।
প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ
-
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন:
“টিউলিপের কর নথি ও ব্যাংক লেনদেনের তথ্য সত্য হলে পরিষ্কার হয় তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। তিনি তদন্ত এড়াতে অসত্য বলছেন।”
-
তিনি আরও বলেন, এটি যুক্তরাজ্যের জন্যও বিব্রতকর পরিস্থিতি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে ব্রিটিশ সরকার তদন্ত করবে।
-
দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের বক্তব্য:
“টিউলিপ আমাদের কাছে একজন বাংলাদেশি নাগরিক। তাই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।”
নিজেকে কেবল ব্রিটিশ নাগরিক দাবি করলেও টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি এনআইডি, পাসপোর্ট, কর ফাইলিং ও ঢাকার ফ্ল্যাটের মালিকানা প্রমাণ হিসেবে হাজির করেছে দুদক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এসব প্রমাণ আদালতে কতটা টিকে থাকবে এবং যুক্তরাজ্যের লেবার সরকার তাঁর বিষয়ে কী অবস্থান নেবে। এই বিতর্ক টিউলিপের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকেই নয়, লেবার পার্টির ভাবমূর্তিকেও বড় ধরনের চাপে ফেলেছে।