
প্রাচীন পুণ্ড্রনগর
প্রায় ১ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার প্রাকৃতিক উঁচু ভূমিতে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন পুণ্ড্রনগর। ভৌগোলিক অবস্থান, নদীপথের যোগাযোগ ও কৌশলগত বিন্যাসের কারণে এটি হয়ে ওঠে উত্তরবঙ্গের একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র। ইতিহাসে পরিচিত ‘পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি’, পাল যুগে এ নগর এক সুবিন্যস্ত ও সংগঠিত নগরীতে রূপ পায়।
নগর ও প্রশাসনিক কাঠামো
পাল যুগ—বাংলার ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়। এই সময়েই পুণ্ড্রনগর স্থাপত্যবিস্ময়ে রূপান্তরিত হয়। নগরের কেন্দ্রে গড়ে ওঠে রাজপ্রাসাদ, প্রশাসনিক কেন্দ্র, কর সংগ্রহের স্থান ও ধর্মীয় মঠ। নগরটি শুধু রাজধানীই নয়, ছিল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভাবনার প্রতিফলন। এর বৈজ্ঞানিক বিন্যাস প্রমাণ করে, পরিকল্পিত নগরায়ণ তৎকালীন শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ ছিল।
ধর্মীয় ও সামাজিক প্রভাব
পাল রাজারা বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হওয়ায় নগরে গড়ে ওঠে বহু মঠ, বিহার, স্তূপ ও প্রার্থনাস্থল। এগুলো শুধু ধর্মীয় উপাসনার কেন্দ্র ছিল না, ছিল বিদ্যা ও সমাজচিন্তারও প্রতিফলন। নগরের উত্তরাংশে ছিল ধর্ম ও বাণিজ্যের কেন্দ্র, দক্ষিণে বাজার ও আবাসন এলাকা। এ বিন্যাস নগরকে এক প্রবহমান সভ্যতায় রূপ দেয়।
আবাসন কাঠামো
১৯৭৬ এবং ১৯৯৩–৯৯ সালের প্রত্নতাত্ত্বিক খননে দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে আবাসন এলাকার সন্ধান মেলে। এসব ঘর একতলা, প্রধানত মাটি ও কাঠের কাঠামোয় নির্মিত।
-
দেয়াল ছিল ৩০–৪০ সেন্টিমিটার পুরু।
-
মেঝে তৈরি হতো মাটি ও পোড়ামাটির টুকরায়।
-
কাঠের খুঁটি ও পোড়ামাটির ভগ্নাংশ ব্যবহৃত হতো নির্মাণে।
-
প্রথমবারের মতো পাওয়া যায় ভাঙা ছাদ টাইলস, যার মাধ্যমে কাঠের কাঠামোয় টাইল ঝুলিয়ে রাখা হতো।
বসতিগুলো সাধারণত উঠান ঘিরে গঠিত, যেখানে ছোট কক্ষ, রান্নাঘর, বারান্দা ও খোলা স্থান ছিল। আধখোলা বারান্দা সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরি করত। ছাদ কাঠামো এমনভাবে নির্মিত হতো, যাতে বর্ষার পানি সহজে নেমে যায়।
বসতিপাড়ার বৈশিষ্ট্য
আবাসন অঞ্চল সমানভাবে বিস্তৃত ছিল না। দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঘনবসতি দেখা যায়। পাড়া গড়ে উঠত পেশাভিত্তিক বৈশিষ্ট্যে—ব্যবসায়ী, কারিগর ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের জন্য আলাদা ঘরবাড়ি থাকলেও কঠোর শ্রেণিভেদ ছিল না।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া টেরাকোটা ফলক, অলংকার, পোড়ামাটির পাত্র ও রান্নার সামগ্রী মানুষের জীবনযাত্রার ছবি তুলে ধরে।
নগরের পরিণতি
পাল সাম্রাজ্যের শেষদিকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুণ্ড্রনগরের বড় অংশ ধ্বংস হয়। খননে এখনো মেলে পোড়া মাটি, কাঠ ও ইটের স্তূপ, যা সেই বিপর্যয়ের নীরব সাক্ষী।
স্থাপত্য ও নগরায়ণের বৈশিষ্ট্য
পাল যুগে মাটি ও কাঠের ব্যবহার প্রচলিত থাকলেও ধীরে ধীরে পোড়ামাটির ইট ও অলংকরণ ব্যবহার শুরু হয়। তৎকালীন জনগণ বহুতল আবাসন নির্মাণে দক্ষ না হলেও একতলা গৃহনির্মাণে ছিল পারদর্শী। নগরে শৌখিন প্রাসাদের পরিবর্তে সাধারণ স্থাপত্যই ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা মানুষের ঐতিহ্য ও সরল জীবনচর্চার প্রতিফলন।
পুণ্ড্রনগর ছিল কেবল একটি প্রাচীরবেষ্টিত নগর নয়, বরং এক প্রবাহমান সভ্যতা। প্রশাসন, ধর্ম, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির সহাবস্থান এ নগরকে অনন্য করেছে। আজকের নগরায়ণ আলোচনায় মহাস্থানের পরিকল্পিত নগর গঠনের শিক্ষা এখনো প্রাসঙ্গিক।