মেট্রোরেল
ঢাকার মেট্রোরেলে যাত্রীর টিকিট পরীক্ষা হয় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে। ঢোকা বা বের হওয়ার সময় যাত্রীকে টিকিট ছোঁয়াতে হয় অথবা জমা দিতে হয় যন্ত্রে। কথা ছিল, প্রতি এক লাখ যাত্রীর মধ্যে একজন প্রথম চেষ্টায় বিফল হবেন। কিন্তু বিফল হওয়ার ঘটনা ঘটছে প্রতি এক লাখে দেড় হাজারের মতো যাত্রীর ক্ষেত্রে।
রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পথে নির্মাণ হওয়া মেট্রোরেল ব্যবস্থায় এমন ৪৫ ধরনের ত্রুটি ও ঘাটতি পেয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। কোম্পানিটির কর্মকর্তারা বলছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজগুলো যথাযথভাবে করেনি, কিংবা চুক্তি অনুসারে যতটুকু কাজ করার কথা ছিল, তা হয়নি।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানিয়েছে, মেট্রোরেলের সংকেত ও টেলিযোগাযোগ কাজে ১০ ধরনের ত্রুটি ও ঘাটতি পেয়েছে কর্তৃপক্ষ। বৈদ্যুতিক কাজের মধ্যে ত্রুটি ও ঘাটতির সংখ্যা ১৬ ধরনের। উড়ালপথ ও অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত পুরকৌশল কাজে পাওয়া গেছে ১০ ধরনের ত্রুটি ও ঘাটতি। আর মেট্রোরেলের ট্রেন এবং এর সঙ্গে যুক্ত ব্যবস্থায় মোট ত্রুটি ও ঘাটতি পাওয়া গেছে ৯ ধরনের।
ডিএমটিসিএলের ৬৩ পৃষ্ঠার একটি নথিতে ত্রুটি ও ঘাটতির বিষয়ে সবিস্তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে সেগুলো পূরণ করে দেওয়ার জন্য ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে একাধিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চিঠির পরও বেশির ভাগ ঘাটতি পূরণ করা হয়নি। কিছু ত্রুটি সারিয়ে দেওয়ার পরও এর পূর্ণাঙ্গ সমাধান হয়নি। এ ছাড়া চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, যে মানের মালামাল সরবরাহের কথা ছিল, তা দেননি ঠিকাদার।
ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ত্রুটি ও ঘাটতির কারণে মেট্রোরেলে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই। তবে চলাচলে বিঘ্ন ঘটা, বারবার মেরামত করাসহ নানা সমস্যা তৈরি হতে পারে। চালুর পর থেকে ৩০-৪০ বার মেট্রোরেলের চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়েছে, যা ২০ মিনিট থেকে ২২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছে।
এদিকে গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেল স্থাপনার বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে গেলে আবুল কালাম নামের এক পথচারী মারা যান। এর আগে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফার্মগেট এলাকাতেই বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল।
চুক্তি অনুসারে, নির্মাণকাজ শেষের দেড় বছর পর্যন্ত যেকোনো ত্রুটি ও ঘাটতি পূরণ করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেই মেয়াদকাল শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ডিএমটিসিএলের বর্তমান কর্তৃপক্ষ চাইছে, ঠিকাদার আরও দুই বছর বিনা পয়সায় ত্রুটি ও ঘাটতি সারিয়ে দিক। এ জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বিগত বছরগুলোতে দায়িত্ব পালন করেছেন আমলারা। আন্তর্জাতিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গত ফেব্রুয়ারিতে এ পদে দায়িত্ব দেওয়া হয় অস্ট্রেলিয়া, ভারত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও হংকংয়ে মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রকৌশলী ফারুক আহমেদকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তিনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্পের ত্রুটি ও ঘাটতি নিয়ে চিঠি লিখে যাচ্ছেন; কিন্তু চাহিদামতো সমাধান পাননি। তিনি আরও বলেন, পুরো প্রকল্পের ত্রুটি ও ঘাটতি নিয়ে বিশদ তদন্ত চলছে। সময় বাড়িয়ে ত্রুটি ও ঘাটতিগুলো সমাধান করতে হবে ঠিকাদার ও পরামর্শককে।
মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। সর্বশেষ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেলের পথ নির্মাণে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে; যা আশপাশের দেশের তুলনায় অনেক বেশি, বিশ্বেই অন্যতম শীর্ষে। তারপরও ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে গেছে।
মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ আটটি ভাগে (প্যাকেজে) ঠিকাদারদের দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পুরো ব্যবস্থার নকশা প্রণয়ন, ঠিকাদার নিয়োগ এবং নির্মাণকাজ তদারকির দায়িত্বে ছিল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশন, যা বেশ কয়েকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত জোট। এর মূল নেতৃত্বে রয়েছে জাপানের নিপ্পন কোই। এ ছাড়া আরও আছে নিপ্পন কোই ইন্ডিয়া, দিল্লি মেট্রোরেল করপোরেশন, যুক্তরাজ্যের মট ম্যাগডোনাল্ড, মট ম্যাকডোনাল্ড ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্টস।
২০১৩ সালে এনকেডিএমকে পরামর্শক হিসেবে প্রায় ১ হাজার ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। ঠিকাদারের কাজ ও পণ্যের মান নিশ্চিত করা এবং যথাযথ কাজ আদায় করার দায়িত্ব পরামর্শকের। তাদের কাছ থেকে পুরো কাজ বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব প্রকল্প পরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তাদের। এ জন্যই ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ ত্রুটি ও ঘাটতির বিষয়ে সরাসরি ঠিকাদারকে কিছু না বলে পরামর্শককে চিঠি দিয়েছে।
মেট্রোরেল প্রকল্পে এনকেডিএমের হয়ে ভারপ্রাপ্ত দলনেতার দায়িত্বে রয়েছেন জাপানের তাকাউকি ফুজিতোমি। বিপুল ব্যয়ে নির্মিত মেট্রোরেল প্রকল্পে ঘাটতি ও ত্রুটি সম্পর্কে বক্তব্য জানতে গত শুক্রবার দুপুরে তাঁকে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হয়। পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে জরুরিভিত্তিতে উত্তর দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। তবে গতকাল শনিবার রাত পর্যন্ত জবাব পাওয়া যায়নি। জবাব পেলে তা প্রকাশ করা হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২২ সালে মেট্রোরেল চালু হয়। ওই সময় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এম এ এন সিদ্দিক ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তাঁর আট বছর কার্যকালেই মেট্রোরেলের ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে নির্মাণকাজ হয়। অন্তর্বর্তী সরকার এসে তাঁকে সরিয়ে দেয়। কেন মেট্রোরেলে এসব ত্রুটি ও ঘাটতি, সে বিষয়ে বক্তব্য জানতে এম এ এন সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তবে তাঁর মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, গত বছরের নভেম্বরে তাঁকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালের হত্যাচেষ্টার একটি মামলায় আসামি করা হয়। এরপর থেকে তিনি প্রকাশ্যে আসছেন না।
বৃষ্টির পানি ঢুকছে স্টেশনে
ডিএমটিসিএলের তথ্য বলছে, তারা মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশনের অন্তত ৮৯ জায়গায় পানি প্রবেশের তথ্য পেয়েছে। বিশেষ করে স্টেশনের প্রবেশ ও বের হওয়ার জায়গায় বেশি পানি পড়ে। এ ছাড়া কর্মীদের বিশ্রামাগারসহ কয়েকটি কক্ষ, লিফট ও এসকেলেটরে প্রবেশের জায়গায় পানি পড়ে।
স্টেশনের ছাদের ফাঁক এমনভাবে তৈরি করা যে বৃষ্টি হলে লাইনের পাশাপাশি প্ল্যাটফর্মেও পানি পড়ে। কনকোর্স হলেও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার (এসি) পাশ দিয়ে পানি আসে। বিভিন্ন স্টেশনের কোন কোন জায়গায় পানি পড়ে, তার ছবিসহ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে সমাধানের অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিছু স্থানে বিশেষ ধরনের টেপ লাগিয়ে মেরামত করা হয়েছে। তবে তা সঠিক মনে করছে না ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ।
বৃষ্টি হলে মেট্রোরেল স্টেশনের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানি ঢোকার বিষয়টি যাত্রীদের নজরেও এসেছে। নিয়মিত যাত্রী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টির সময় ট্রেনের অপেক্ষায় প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালে ভিজে যেতে হয়। এর বাইরেও স্টেশনে পানি জমে থাকতে দেখেছেন তিনি।
জায়গামতো দরজা খোলে না
মেট্রোরেলের ট্রেনের দরজা প্ল্যাটফর্মে সুনির্দিষ্ট জায়গায় থামার কথা। কিন্তু ঢাকার মেট্রোরেলে বেশির ভাগ স্টেশনে ট্রেন সুনির্দিষ্ট স্থানের কিছুটা আগে বা পরে থামছে। ট্রেন থামার সময় ঝাঁকিও হয়। সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি ডিএমটিসিএলের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে; কিন্তু পরিস্থিতি খুব একটা উন্নতি হয়নি।
ডিএমটিসিএলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মেট্রোট্রেনের দরজার চেয়ে প্ল্যাটফর্মের দরজা কিছুটা বড়। ফলে ট্রেন নির্ধারিত স্থানের কিছুটা আগে-পড়ে থামলেও তাতে বড় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু এটা সুনির্দিষ্ট জায়গায় থামার কথা।
চুক্তি অনুযায়ী, টিকিট কাটার যন্ত্র বা ভেন্ডিং মেশিন থেকে প্রতি মিনিটে পাঁচটি টিকিট কাটতে পারার কথা। প্রতি মিনিটে ৬০ জন যাত্রী প্রতি গেট দিয়ে বের হতে পারার কথা; কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। গত এক বছরে ‘লোকাল কন্ট্রোল ইউনিট’ ১৩ বার বিকল হয়েছে, যার ফলে যাত্রীদের স্টেশন গেট দিয়ে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশে সমস্যা হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় ভাড়া আদায়ের যে ব্যবস্থা, তা চাহিদামতো মানে সরবরাহ করা হয়নি। পুরোনো সংস্করণের কম্পিউটার দিয়ে কাজটি করা হচ্ছে। এ ছাড়া স্টেশনে ব্যবহৃত লিফট ও এসকেলেটরে নানা অসংগতি ও ক্ষয়ের তথ্য পেয়েছে ডিএমটিসিএল।
ইলেকট্রনিক ব্রেক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বেশ কয়েকবার ঠিকমতো কাজ করেনি। এর ফলে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়েছে। সাতটি ট্রেনে ‘পাওয়ার বোর্ড কার্ড’ (ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ) বদলে দিয়েছে ঠিকাদার। বাকি ১৭টি ট্রেনে এখনো বদলানো হয়নি। কর্মকর্তারা বলছেন, সব ট্রেনেই এটি বদলানো দরকার। এ ছাড়া ট্রেনের ব্রেক ব্যবস্থায় ৩০২টিতে সামান্য চিড় পাওয়া গেছে। বদলানোর পরও এই সমস্যা রয়ে গেছে। ট্রেনের ‘সেন্সরে’ ত্রুটির কারণেও ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়েছে। ঠিকাদার সব সেন্সর বদলে দিলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়েছে বহুবার। মূল বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার সহযোগী ব্যবস্থায় কিছু সমস্যা আছে।



.png)
.png)