 
					ফ্ল্যাট
নিজদের বসবাসের জন্য কোনো আবাসন কোম্পানির প্রকল্পে একটি অ্যাপার্টন্টে কিনেছেন। সেখানে বাস করছেনও দীর্ঘসময় ধরে। হঠাৎ করেই একদিন দেখলেন, ওই অ্যপার্টমেন্ট বা পুরো ভবন খেলাপি ঋণ আদায়ে নিলামে তুলেছে ব্যাংক। এবার ওই জায়গায় নিজের ও পরিবারের বিস্ময় ও অসহায়ত্ব কল্পনা করুন।
ঢাকায় এমন দুঃস্বপ্ন এখন শত শত ফ্ল্যাটমালিকের বাস্তবতা। কারণ, কিছু ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান নির্মাণের আগে বা চলাকালীন সময়ে প্রকল্পগুলো গোপনে ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে মোটা অংকের ঋণ নিয়েছেন, অথচ সে বিষয়ে ক্রেতাদের কখনোই জানায় না।
এরপর যখন আবাসন কোম্পানির ঋণ খেলাপি হলে— সেটি আদায়ে ব্যাংক মামলা করেছে। তখন আদালত সেই মামলার রায় ব্যাংকের পক্ষে দিয়েছে। রায়ে ওই সম্পত্তি যখন নিলামে উঠেছে, তারপরই অ্যপার্টমেন্টের ক্রেতা বা বাসিন্দারা জানতে পারছেন, আর হতবাক হয়ে পড়ছেন।
আইনি লড়াই বাড়ছে
আদালতের নথি বলছে, এরকম প্রতারণার শিকার হয়ে হাইকোর্টে নিলাম ঠেকাতে এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১,০৭৬ টি রিট দায়ের হয়েছে, যার সাথে জড়িত ক্রেতাদের প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ। শতাধিক আবাসন কোম্পানির বিরুদ্ধে এসব মামলা হয়েছে।
গত চার বছর ধরে এ ধরনের মামলার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে:
•    ২০২৪ সালে হয়েছে ৭৫৪টি রিট, যার সাথে প্রায় ১,০৫০ কোটি টাকা জড়িত।
•    ২০২৩ সালে ৮১৩টি রিট, যার সাথে জড়িত ১,০০০ কোটি টাকা।
•    ২০২২ সালে ৬১৮টি রিট, যার সাথে জড়িত ৮০০ কোটি টাকা।
•    ২০২১ সালে ৫৬৯টি রিট, জড়িত ৭৫০ কোটি টাকা।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন– রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) কাছে গত সেপ্টম্বর পর্যন্ত এরকম প্রতারণার ঘটনায় প্রায় ৩৪০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। যার সাথে গ্রাহকের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা জড়িত।
'ক্রেতারা আইনি অন্ধকারে'
রিহ্যাব সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, যেসব অভিযোগ জমা পড়েছে এরমধ্যে ৫০ শতাংশ কোম্পানি রিহ্যাবের সদস্য নয়। এছাড়াও এরকম প্রতারণার ঘটনায় আবাসন কোম্পানির সদস্যপদ স্থগিত করা ছাড়া—আর কোনো আইনগত প্রতিকার দিতে পারে না রিহ্যাব। ফলে নিজেদের সম্পদ ও বিনিয়োগ রক্ষায় হাইকোর্টে রিট বা প্রতারণার মামলা করছেন ভুক্তভোগীরা।
এখানে কার কী করণীয়, এবিষয়ে রিহ্যাব সভাপতি ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, "সাধারণত ব্যাংক কোনো সম্পত্তি বন্ধক নিলে, সেটির সামনে ওই সম্পত্তি দাগ নম্বর বা স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করে বন্ধকীর সাইনবোর্ড ঝুলানোর কথা। কিন্তু অভিযুক্তরা ব্যাংক বা নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগসাজশ করে সাইনবোর্ড ঝুলায় না, ফলে গ্রহকরাও সঠিক তথ্য পায় না।"
তিনি বলেন, একজন সাধারণ অ্যাপার্টমেন্টে ক্রেতার পক্ষে কোনাভাবেই সম্ভব নয়, প্রতিটি ব্যাংকে গিয়ে ওই ভবন বা জমির বিষয়ে তথ্য যাচাই করা। তাই বন্ধকী সম্পত্তির বিষয়ে দৃশ্যমান সাইনবোর্ড ঝুলানো অবশ্যক করতে হবে। নাহলে সম্পত্তি আইনগত দিক নিয়ে ক্রেতারা অন্ধকারেই রয়ে যাবেন।"
তাছাড়া বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বন্ধকী সম্পত্তির তালিকা সংরক্ষণ করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্তৃপক্ষ থাকে। যেটি বাংলাদেশে নেই। একটি ডিজিটাল ডেটাবেইজে ওইসব দেশে বন্ধকী রাখা সম্পত্তির সব তথ্য থাকে। বাংলাদেশেও এরকম ব্যবস্থা স্থাপন করা এখন সময়ের দাবী বলে উল্লেখ করেন রিহ্যাব সভাপতি ওয়াহিদুজ্জামান।
ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংয়ের ঘটনা
এরকম ভুক্তভোগীদের একজন, ডা. রফিকুল বারী, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে উত্তরার 'ব্রাইট সাউথ' প্রকল্পে ১,২৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনেন। প্রায় দেড় কোটি টাকা পরিশোধের পর ওই বছরের এপ্রিল মাসেই ফ্ল্যাটে পরিবারসহ বসবাস শুরু করেন।
ভালোভাবেই বসবাস করছিলেন তিনি। ঠিক এক বছর পর হঠাৎ করে একদিন কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য বের হতেই চোখে পড়ে ১২ ইউনিট বিশিষ্ট ওই ছয় তলা ভবন পুরোটাই নিলামে বিক্রি করার নোটিশ। আর এই নোটিশ দিয়েছে সোনালী ব্যাংক উত্তরা শাখা।
ঢাকার অর্থঋণ আদালত-৩ ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংয়ের ৩০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য ভবনটি নিলামে তোলার নির্দেশ দেন। ডা. রফিকুল বারী জানান, ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটি তাকে শুধুমাত্র অস্থায়ী সম্পাদন দলিল দিয়েছিল। মূল দলিল করে দিতে দীর্ঘদিন ধরে তালবাহানা করে আসছিল।
পরে তিনি জানতে পারেন, কোম্পানির চেয়ারম্যান আখতার হোসেন সোহেল ভবনটি ২০১২ সালেই বন্ধক রেখে ২১ কোটি টাকা ঋণ নেন এবং সেই ঋণ তিনি আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
রফিকুল বারী বলেন, "আমরা মহা-বেকায়দায় পড়ি, ২০ দিন পড়েই নিলামের তারিখ ধার্য রয়েছে। এমতাবস্থায় কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে একজন আইনজীবীর পরামর্শ নিই। এরপর নিলাম ঠেকাতে হাইকোর্টে একটি রিট করি এবং একই সাথে ঢাকার আদালতে প্রতারণার মামলা দায়ের করি। পরবর্তীতে মানবিক কারণে হাইকোর্ট নিলাম স্থগিতের আদেশ দেন।"
তদন্তকারীরা জানান, সোহেল একই কৌশলে রাজধানীর মিরপুর, খিলখেত ও উত্তরায় অন্তত সাতটি প্রকল্পে প্রতারণা করেছেন। প্রায় ৫০টি মামলার আসামি এই ব্যবসায়ীকে গত ২১ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয়; তার বিরুদ্ধে ৪০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে নিলামের উদ্যোগকে সমর্থন করে সোনালী ব্যাংকের আইনজীবী ওয়ালিউর রহমান বলেন, "ব্যাংক তার খেলাপি ঋণ উঠানোর জন্য মামলা করে। এটি একটি আইনি পথ। কোনো কোম্পানি যদি গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করে, সেটির দায়িত্ব ওই কোম্পানিকেই নিতে হবে। আদালতের রায় অনুযায়ী, বন্ধকী সম্পত্তি ব্যাংক নিলামে বিক্রয় করতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, কোনো সম্পত্তি বন্ধক নেওয়ার পর—ব্যাংক সেটিতে বন্ধকীর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। কিন্তু, ব্যাংক সাইনবোর্ড লাগালেও অনেক সময় ভবন বা জমির মালিকপক্ষ তা খুলে ফেলে—এটা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
নিজের ফ্ল্যাটে থাকতে হচ্ছে ভাড়া দিয়ে
পূর্ব রামপুরার বাসিন্দা রাফিউর রহমানের জন্য এই অভিজ্ঞতা আরও বিপর্যয়কর।ওই এলাকায় তিতাস রোডে ঝলক হাউজিং তাদের একটি প্রকল্পের চারটি ফ্ল্যাট ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখেছিল। পরে ৫ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয় কোম্পানিটি। বায়িং হাউজিং কর্মকর্তা রাফিউর রহমানসহ চারজন ওই ফ্ল্যাটগুলো কিনেছিলেন। ২০২২ সালে হঠাৎ করেই তাঁরা জানতে পারেন, এবি ব্যাংকের কাছে ৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে আদালত রায় দিয়েছেন। রায়ের পর নিলামে উঠানো হয় ওই চারটি ফ্ল্যাট। কিন্তু কোনো দরদাতা না পেয়ে ওই চারটি ফ্ল্যাট ব্যাংক নিয়ে নেয়।
রাফিউর রহমান বলেন, "ব্যাংক ওই ফ্ল্যাটগুলো নেওয়ার পর আমরা চারজনই ১৫ টাকা করে মাসিক ভাড়া দিয়েছি। আমার তিন প্রতিবেশী এসব ফ্ল্যাট ছেড়ে এখন অন্য জায়গায় চলে গেছে। আমি এখনো প্রতিমাসে ভাড়া গুনছি, অথচ এই ফ্ল্যাটটি আমার কেনা।
তিনি বলেন, প্রতারণার অভিযোগে আমরা ঢাকার আদালতে মামলা করেছি, মামলার বিচার চলছে। কবে নাগাদ এই বিচার শেষ হবে জানি না। ঝলক হাউজিংয়ের আরো কয়েকটি প্রকল্পে এরকম আরো ১৫ জনের বেশি প্রতারণার শিকার হয়ে মামলা করেছেন বলে জানান রাফিউর রহমান।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সম্পত্তি বন্ধক নেওয়ার পর সেটিতে বন্ধকীর সাইনবোর্ড ঝুলানো বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী বাধ্যতামূলক। এছাড়াও ব্যাংকের ঋণদাতা শাখা ওই সা্ইনবোর্ড রয়েছে কি-না, সেটি প্রতিনিয়ত পরিদর্শন করার কথা। "সেটি না করার কারণেই জমি বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে অনেক সময় প্রতারণার শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। এটি নিশ্চিত করতে হবে।"
প্রতারণা ঠেকাতে নেই সরকারের কার্যকর উদ্যোগ
রিহ্যাবের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কামাল মাহমুদ বলেন, "আবাসন খাতের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ হয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কিন্তু নাগরিকরা এরকম সমস্যায় পড়লে সরকারের পক্ষ থেকে সেগুলো সমাধানে বা কাউকে জবাবদিহিতায় আনার কোনো নির্দিষ্ট সেল বা কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে প্রতারক আবাসন কোম্পানিগুলো বেপরোয়া।"
তবে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলেন, এরকম অভিযোগ আসলে সেটি তদন্ত করে রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী, এরকম কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল করা হয়। জরিমানাও করা হয়।
কামাল মাহমুদ অভিযোগ করেন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যে কাজ করে তা যথেষ্ট নয়। এরকম অভিযোগ আসলে কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে কোম্পানিগুলো পার পেয়ে যায়।
বন্ধকী দলিলের তথ্য প্রতারক কোম্পানি ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গোপন করা হয়—এমন অভিযোগ করেছেন অ্যাপার্টমেন্ট ক্রেতারা।
তবে সাব-রেজিস্ট্রারদের সংগঠন– বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআরএসএ) কার্যনির্বাহী সদস্য শেখ কাউসার আহমেদ বলেন, যে অনিয়মের কথা বলা হচ্ছে, এর দায় শুধু সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ওপর চাপানো ঠিক না।
তিনি বলেন, "একটি দলিল সম্পাদনের পর সেটির তথ্য সংশ্লিষ্ট এসিল্যান্ড অফিস-সহ আরো কিছু জায়গায় রেকর্ড হয়। শুধু সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে বন্ধকী দলিলের খোঁজ নিলে হবে না, দলিল হওয়ার পর সেটির খারিজ খতিয়ান (মিউটেশন) হয়, সেটিরও তথ্য যাচাই করতে হবে। সব পর্যায়ে সঠিকভাবে যাচাই করা হলে ক্রেতাদের এমন প্রতারণার শিকার হতে হবে না।"



 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										 
										.png)
.png)
 
									 
									 
									 
									 
									 
									 
									