গ্যাস ফিল্ড
দেশে প্রতিবছর কমছে গ্যাসের উৎপাদন। চড়া দামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করেও চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। চাহিদামতো গ্যাস পাচ্ছে না শিল্পকারখানা। আটকে আছে নতুন বিনিয়োগ। অথচ অবহেলায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে দক্ষিণের দ্বীপজেলা ভোলার গ্যাস। এ গ্যাস ব্যবহার নিয়ে আড়াই দশক পরও কার্যকর পরিকল্পনা নিতে পারেনি সরকার।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, ভোলায় উৎপাদিত গ্যাস জেলার বাইরে আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। জেলার ভেতরেও উৎপাদন সক্ষমতা অনুসারে গ্যাসের ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ১৫ কোটি ঘনফুট উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও ব্যবহৃত হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ কোটি ঘনফুট গ্যাস। আরও দুটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদনই শুরু হয়নি।
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় ১৯৯৫ সালে শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)। শাহবাজপুর থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয় ২০০৯ সালে। একই সংস্থা ২০১৮ সালে আবিষ্কার করে ভোলার দ্বিতীয় গ্যাসক্ষেত্র ভোলা নর্থ। তারা ২০২৩ সালে আবিষ্কার করে ইলিশা গ্যাসক্ষেত্র। এ দুটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে এখনো উৎপাদন শুরু হয়নি।
শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ১৫ কোটি ঘনফুট উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও ব্যবহৃত হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ কোটি ঘনফুট গ্যাস। আরও দুটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদনই শুরু হয়নি।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, ভোলার তিনটি গ্যাসক্ষেত্র মিলে ১ হাজার ৪৩২ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ) গ্যাসের মজুত থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ভোলায় মোট গ্যাস উৎপাদিত হয়েছে ২০০ বিলিয়ন ঘনফুটের (বিসিএফ) কম। তবে নতুন কূপ খননের পর মজুত আরও বাড়তে পারে।
দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হচ্ছে এখন ১৭৭ কোটি ঘনফুট। ২০১৭ সালেও দেশে দিনে উৎপাদিত হয়েছে সর্বোচ্চ ২৭০ কোটি ঘনফুট। এর পর থেকে গ্যাসের উৎপাদন টানা কমছে। ঘাটতি মেটাতে ২০১৮ সাল থেকে চড়া দামের এলএনজি আমদানি শুরু করে সরকার।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, ভোলার তিনটি গ্যাসক্ষেত্র মিলে ১ হাজার ৪৩২ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ) গ্যাসের মজুত থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ভোলায় মোট গ্যাস উৎপাদিত হয়েছে ২০০ বিলিয়ন ঘনফুটের (বিসিএফ) কম। তবে নতুন কূপ খননের পর মজুত আরও বাড়তে পারে।
সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়নি
গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পর নব্বইয়ের দশকে ভোলার গ্যাস জেলার বাইরে আনার প্রস্তাব দিয়েছিল বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিকল। ১২০ কিলোমিটার পাইপলাইন করার কথা বলেছিল তারা। এ গ্যাস ব্যবহার করে ভোলা, বরিশাল ও খুলনায় বিদ্যুৎকেন্দ্র করারও প্রস্তাব দিয়েছে ইউনিকল। এটি লাভজনক হবে না ভেবে এগোয়নি তৎকালীন সরকার। এত বছর পরও এটি লাভজনক হবে কি না, তার সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়নি।
ভোলার গ্যাস বাইরে নিতে পাইপলাইন নির্মাণে গত সরকারের সময় মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে আলোচনা করে পেট্রোবাংলা। ভোলা থেকে বরিশাল হয়ে খুলনায় যাওয়ার কথা এ পাইপলাইন। আরেকটি পাইপলাইন বরিশাল থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। ভোলার গ্যাস বরিশাল পর্যন্ত আনতে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। বরিশাল থেকে সরাসরি ঢাকায় পাইপলাইন আনার সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে এখন। ডিসেম্বরে এ প্রতিবেদন পাওয়া যেতে পারে।
এ ছাড়া ভোলার গ্যাস রূপান্তর করে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) হিসেবে বাইরে আনার চিন্তাও আছে জ্বালানি বিভাগের। একাধিক কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। পাইপলাইনের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে যেটি সবচেয়ে লাভজনক হয়, সে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভোলার গ্যাস নিয়ে গভীরভাবে ভাবা হচ্ছে। সিএনজির বড় সিলিন্ডারে ভরে মেঘনাঘাট পর্যন্ত এনে শিল্পে সরবরাহ করা যেতে পারে। এলএনজি করার বিষয়টিও বিবেচনায় আছে। পাইপলাইনের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনটি পেলে এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
ভোলায় বাড়ানো হয়নি চাহিদা
ভোলায় গ্যাস উৎপাদনের কাজটি করছে বাপেক্স। আর বাপেক্সের কাছ থেকে কিনে নিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে তা সরবরাহ করে সুন্দরবন গ্যাস বিতরণ কোম্পানি।
বাপেক্স সূত্র বলছে, গ্যাস উৎপাদনের পর প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পাইপলাইনে সরবরাহ করা হয়। শুরু থেকেই ৭ কোটি ঘনফুট গ্যাস প্রক্রিয়াকরণের একটি ইউনিট কাজ করছে শাহবাজপুরে। এরপর ২ কোটি ঘনফুটের একটি ইউনিট এনে অস্থায়ীভাবে বসানো হয়। দুই বছর আগে আরও ৬ কোটি ঘনফুট প্রক্রিয়াকরণের একটি ইউনিট করা হয়েছে। যদিও উৎপাদন সক্ষমতা পড়ে থাকছে। চারটি কূপ থেকে গত বুধবার উৎপাদিত হয়েছে ৭ কোটি ১০ লাখ ঘনফুট গ্যাস। গ্যাস নিতে পারছে না ভোক্তা পর্যায়ে এখানকার সরবরাহকারী সংস্থা সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি।
সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি বলছে, ভোলায় তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, দুটি ক্যাপটিভ (শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎ), শিল্পকারখানা ও আড়াই হাজার বাসায় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। আর নতুন ক্রেতা নেই। ভোলায় নতুন করে শিল্পকারখানা হয়নি। তাই কয়েক বছর ধরে চাহিদা আর বাড়ছে না। খুলনায় গ্যাস নিতে পারলে সরবরাহ বাড়ানো যেত।
বিশ্ববাজারে ২০২২ সালে এলএনজির দাম নাগালের বাইরে যাওয়ার পর ভোলার গ্যাসের ব্যবহার নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে সরকার। কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস (সিএনজি) সিলিন্ডারে ভরে ভোলার গ্যাস ঢাকায় এনে শিল্পকারখানায় সরবরাহের উদ্যোগ নেয় সরকার।
প্রথম পর্যায়ে সিএনজি আকারে ভোলার গ্যাস সরবরাহের কাজ পায় সিএনজি খাতের কোম্পানি ইন্ট্রাকো। দিনে সরবরাহের কথা ৫০ লাখ ঘনফুট। ভোলা থেকে সিলিন্ডারে ভরে গ্যাস আনা শুরু হয় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। বিভিন্ন বড় শিল্পকারখানা থেকে চাহিদাও আসতে থাকে নিয়মিত। তবে সিলিন্ডারে ভরে দিনে গ্যাস আসছে খুবই সামান্য। প্রায় দুই বছর পরও দিনে গ্যাস আসছে ৮ লাখ থেকে ৯ লাখ ঘনফুট।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গ্যাস-সংকট শুরুর পর সিলেট এলাকায় অনেক শিল্পকারখানা হয়েছে শুধু গ্যাস থাকার কারণে। ভোলায় জমি, গ্যাস, বিদ্যুতের সুবিধা পর্যাপ্ত। নদীপথে চট্টগ্রাম বন্দরে মালামাল পরিবহনেরও ব্যবস্থা আছে। অথচ এখানে তেমন বিনিয়োগ নিয়ে আসতে পারেনি সরকার।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম বলেন, ভোলায় বিনিয়োগ উৎসাহী করে গ্যাসের চাহিদা বাড়ানো যেত। পাইপলাইন করে বাইরে আনা হলেও গ্যাস-সংকটের অনেকটা সুরাহা হতো। ভোলায় আরও গ্যাসের সম্ভাবনা আছে। গত সরকার অবহেলা করেছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বলে হয়তো বর্তমান সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।দ



.png)
.png)